রসহীন কষ

আমার স্ত্রীর নাম আপনাদের বলব না, বললে আপনারা তাকে চিনে ফেলতে পারেন। না-না, যা ভাবছেন, ঘটনা সেরকম না, ও সিনেমার নায়কা-টাকিয়া নয়, সামান্য একজন শিক্ষিকা মাত্র। একটা প্রতিবন্ধীদের স্কুলে পড়ায়। সাইকোলজির ছাত্রী ছিল। সেখানে ও দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছিল, অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্টক্লাস। বড় বড় চাকরির অফার থাকা সত্ত্বেও কোথায় জয়েন না করে, প্রতিবন্ধীদের সংস্পর্শে থেকে তাদের নিয় কিছু উচ্চতর গবেষণা করা। অতি সম্প্র ওর এমনই একটা গবেষণা আলোড়ন সৃষ্টি করায় পত্র-পত্রিকায় ছবি-টবি এসেছে।
এজন্যই ওর নাম বলতে আমার দ্বিধা। অবশ্য গল্প যখন বলতে বসেছি, একটা নাম তো তার বলতে হবে । ধরা যাক, ওর নাম ইভা।
গল্পটা হলো বিয়ের দুই বছর পর আমি হঠাৎ করে একজন ভদ্র মহিলার প্রেমে পড়েছি। কাহানিটা খোলসা করে বলা যাক। ইভা যে স্কুলে মাস্টারি  করে সেই স্কুলে সেদিন গিয়েছিলাম। প্রতিবন্ধীদের (পাগল বললে ইভা ভীষণ ক্ষেপে যায়, ওদেরকে প্রতিবন্ধী বললে ও খুশি হয়) স্কুল কেমন হয় এটা দেখার ইচ্ছা অনেক দিন থেকেই। কিন্তু ঠিক চান্স পাচ্ছিলাম না। বিয়ের পর বেশ কয়েকবার ওকে বলেছিলাম, তোমার স্কুলে একদিন বেড়াতে যবো। ও ভ্রু কুচঁকে বলেছিল, কেন, ওটা কোনো বেড়ানোর জায়গা না কি? তুমি কী অদ্ভুত কথা বল!
 আমি আবার আমার স্ত্রীকে হালকা ভয় পাই, মতান্তরে সমীহ করে চলি। কাজেই সেবার খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলাম, আরে না বেড়াতে যাব, আসলে প্রতিবন্ধীদের স্কুল কেমন হয়- এটা দেখার খুব ইচ্ছা । ওদের
ব্যাপারটা খুব আগ্রহ বোধ করি কি না, তাই বলছিলাম। জায়গাটা নিশ্চিয়ই খুব ইন্টারেস্টিং । কথাটা শুনে ও আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, আমার স্কুল ফ্যান্টাসি কিংডম না আবার চিড়িয়াখানাও না যে ওখানে ইন্টারেস্টিং কিছু পাবা। ওদের নিয়ে এভাবে কথা না বললেই খুশি হবো। ব্যাস, ব্যাপারটা এখানেই থেমে গিয়েছিল। আর যাওয়া হয়নি। সেদিন আচমকা সুযোগটা এসে গেল। ওদের স্কুলে কি একটা ফাংশন হবে, সব টিচারদের সেখানে সপরিবার দাওয়াত। সেদিন একটা এনজিও স্কুল পরিদর্শনে আসবে, স্কুল দেখে তারা খুশি হলেই মোটা অংকের বিদেশী অনুদান জুটে যাবে। এরকম কী একটা গোলমেলে ব্যাবারের মধ্যে আমার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ ঘটে গেল।
  গেলাম, স্কুলে গিয়েই আমার দুই বছর ধরে চেনা স্ত্রীকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম এবং আশ্চার্যজনকভাবে আচমকা প্রেমে পড়ে গেলাম। "ল্যাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট" যাকে বলে। স্কুলটা বেশ সুন্দর। প্রতিটি ক্লাসরুম বেশ সুন্দর করে সাজানো, ছিমছাম, পরিপাটি। ক্লাসে বেঞ্চে-টেঞ্চ নেই, একটা হাফ চাঁদের মতো অর্ধগোলাকার টেবিল, ছোট ছোট চেয়ার। ওখানে ছাত্রাছাত্রীরা বসে। টিচারও ওখানে বসেই ওদের পড়ান, অনেকটা প্রাইভেট টিউটররা যে স্টাইলে বাসায় এসে ছাত্র পড়িয়ে যায়, ব্যাপারটা সেরকম। আমার সামনেই ওদের একটা ক্লাস নিল। সর্বমোট পাঁচজন ছাত্রছাত্রী, একেকটা মহা বিচ্ছু। টিচার কী বলছে সেদিকে মনোযোগে নেই, দেদারছে দুষ্টমি করে যাচ্ছে। একজন আরেকজনেক পেন্সিল কেড়ে নিচ্ছে, কেউ আনমনে হা করে বসে মুখ নিয়ে বিকট জোরে চিৎকার দিচ্ছা।
    এদের বয়স কিন্তু একেবারে কম না, একেকজনের ষোল-সতের হবে । আশ্চর্যের বিষয় ইভা একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। বরং হাসিমুখে ওদের বলছে, আমরা একটু পড়াশুনা করে নিই, তারপর না হয় সবাই মিলে অনেকক্ষণ ধরে দুষ্টুমি করবো, কেমন? আমি অবাক, এই ইভাকে তো আমি চিনি না। এ কোন ইভা, এত সহনশীল এত হাস্যময়ী। আমার মনে আছে, বিয়ের পর ওকে একদিন বলেছিলাম, তোমার চেহারা উর্মিলার মতো।
   উর্মিলা কে?
উর্মিলাকে চেন না? বোম্বের হিরোইন। ক্যায়সা ফিগার, সুপারহিট নায়িকা, হেভি হট।
   ইভা আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ছি। তুমি এইভাবে কথা বলতে পারো! এই তোমার রুচি! আর আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলবে না।
 এ জন্যই আমার বন্ধুরা বলত, তোর বউ হেভি মুডি । যেরকম রাগি, তুই তোর বউয়ের সাথে প্রেম করিস কী করে ভাই?
আয় শালারা দেখে যা, ইভা আসলে কি রকম। এই যে ছেলেটা কানের কাছে এত জোরে চিৎকার দিল অথচ ইভা কিছুই বললো না। আমার মনে আছে বিয়ের পর একদিন বাসায় পত্রিকার হকারের সাথে চিৎকার করেছিলাম দেখে ইভা হকারের সামনেই আমাকে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, জোরে কথা বলবে না। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু চিৎকার চেচামেচি মোটেও টলারেট করতে পারি না। প্লিজ, তুমি আস্তে কথা বলো। গত দু'বছরে আস্তে আস্তে বুঝেছি, ও অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে না, অনেক ব্যাপারই পছন্দ করে না। চিৎকার করা পছন্দ করে না, তরকারিতে ঝাল পছন্দ করে না, বাংলা সিনেমা পছন্দ করে না ( আমিও পছন্দ করি না তবে হিন্দি সিনেমা আমার জোস লাগে, ও সেটাও পছন্দ করে না। গোবিন্দ ওর দুছোখের বিষ আমি গোবিন্দর ফ্যান) ঠাট্টা-মস্কারা একদম ওর ভালো লাগে না। জোরে হাসা, ঘরের ভেতরে খালি গায়ে থাকা , দাঁত পরিষ্কার করতে গিয়ে বেসিনের আয়নায় পেস্ট লাগিয়ে ফেলা, বাথরুমে দেরি করা, সিগারেট কিংবা পান খাওয়া, কারও সাথে যেচে কথা বলা, বেশি কথা বলা, এক কথা বারবার বলা, অযথা ঘ্যান ঘ্যান করা, উন্মাদ ম্যাগাজিন পড়া, মানুষজনের ভীড় ইত্যাদি ইত্যাদি ওর ভীষণ অপছন্দের বিষয়। ( তালিকাটা দীর্ঘ হতে পারতো এই মুহুর্তে সবকিছু মনে না আসায় উল্লেখ করতে পারলাম না। তবে আমার ডায়েরিতে সব নোট করা আছে।)
অথচ আশ্চর্যের বিষয় ক্লাসে তাকে পুরো এক ঘন্টা ক্রমাগত ঘ্যানর ঘ্যানর করতে দেখলাম। একজন উল্টসিধা ঘ্যানর ঘ্যানর করে গেল সেটাও সে খুব মনযোগ দিয়ে শুনলো, একটুও বিরক্ত হতে দেখলাম না। সেদিন বাসায় ফিরলাম একটা ঘোরের মধ্যে। আমার ক্যালকুলেশনে কোথাও একটা বড় ধরনের গোলমাল আছে। ইভা তো এরকম না, আমি যে রকম তাকে এতদিন ভেবে এসেছি। ও গল্প করতে পারে, ও হাসতে পারে ( হাসলে ওকে আশ্চর্য রকমের সুন্দর দেখায়), এমনকি ঘ্যানর ঘ্যানরেও তার খুব একটা অরুচি নেই। তাহলে আমি এতদিন যা ভেবে এসেছি তা ভুল!
 সেদিনদথেকে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ওই দিন ইভা বাসায় ফিরতেই ওকে চেপে ধরলাম। বললাম, তোমাকে সব কথা বলতেই হবে, তা না হলে আজকে থেকে লাগাতার হরতাল ।
ইভা মহা বিরক্ত হয়ে বললো, আজ থেকে লাগাতার হরতাল মানে? তোমাকে না বলেছি হেয়ালি করে আমার সাথে কথা বলবে না, হেয়ালিপনা আমার একদম ভালো লাগে না।
লাগে তো, কানের কাছে মুখ নিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বললাম, নিশ্চই লাগে। স্কুলে তো দেখলাম তোমার সবই ভালো লাগে। এই যে কানের কাছে চিৎকার দিলাম, তুমি এমন করে তাকাচ্ছ কেন, প্রাণ ভোমরা, স্কুলে তো ঐ ছেলেটির দিকে এমন বিষচোখে তাকাওনি। ঘরে তুমি হাসো না, আমি ভাবতাম তুমি হাসতেই জানো না। কিন্তু আমার সেই ধারনা ভুল, স্কুলে তো দেখলাম তুমি  দারুন হাসো, বকবকও করতে পারো। স্কুলে গিয়ে আমার ওই কি যেন বলে, হ্যা পেয়েছি- স্কুলে যেয়ে আমার জ্ঞান চক্ষু উন্মীলন হলো। তুমি তো সবই পারো , সবই করো।
এইযে তুমি তো, সেই তুমি নও।
ইভা মহা বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তরপর খুব ধীরে ধীরে বলল, ওরা প্রতিবন্ধী। ওরা তো এমনই করবেই। তুমি ওদের সাথে নিজেকে মেলাচ্ছ কেন? ওদের ওইসব অ্যাটিচ্যুড। আমি নিজেও পছন্দ করি না, তারপরও অ্যাপ্রিসিয়েশন করি। করতে হয়, এটাই তো আমালর ডিউটি। ওদেরকে এভাবেই মোটিভেট করতে হয়।
ওরা উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললাম, ওরা প্রতিবন্ধী হলে আমিও প্রতিবন্ধী মনে ওদের মতো পাগল-ছাগল হয়ে যাবো। আমি এখন ওই মেয়েটার মতো  তোমার ঘাড়ে চড়বো। গেট রেডি।
 সত্যি সত্যি ঘাড়ে চড়ার বেষ্টা করতেই একটা আর্তচিৎকার দিয়ে ইভা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। খাটের কোণায় লেগে মাথাটা টং করে ওঠলো। আমচকা চোখের সামনে দুনিয়াদারি সব অন্ধকার হয়ে গেল।
এই গল্পের শেষটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। গল্পের নায়ক জাহিরুল আলমকে ঐ রাত্রেই হাসপাতালে নিতে হয়। খাটের কোনায় ধাক্কা লেগে মাথায় মেজর একটা ইনজুরি হয়েছে । এরপরের কাহিনিও প্রায় বাংলা সিনেমার কাছাকাছি, মাথায় আঘাত পেয়ে জহির এখন নিজেই প্রতিবন্ধী, জাহিরের ভাষায় পাগল-ছাগল। ইভা ভালো মেয়ে, জহিরের খুব সেবা-যত্ন করছে। জহির এখন যখন তখন চিৎকার দেয়, হৈচৈ করে, মাঝে মাঝে কাপড়-চোপড় খুলে ঘরময় দৌড়াদৌড়ি করে। ইভা এতে একটুও মাইন্ড করে না। বরং ওর সাথে পাগলামিতে অংশ নেয়। সাইকোলজিতে দু দুটো ফার্স্টক্লাস পাওয়া ইভার মতে, এভাবে অ্যাপ্রিসিয়েশনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের ট্যাকল করতে হয়, মোটিভেট করতে হয়। ওদের সংসারে আজ আর কোনো অশান্তি নেই। ইভা সুখী, সুখী জহিরও।
পুনশ্চ: গল্পটা শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। ঘটনা সত্যি কি না জানি না। তবে আমার সঘই বন্ধু বলেছে, একদিন সে আমাকে জহিরের বাসায় নিয়ে যাবে। আমারও খুব ইচ্ছা জহিরকে দেখার। কাছে পেলে একটু বাজিয়ে দেখতাম, ব্যাটা সত্যি সত্যি পাগল, নাকি পাগলের ভাব ধরেছে।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !