“নানার গাড়ি”
ছোটবেলায় রেলগাড়িকে বলতাম, নানার গাড়ি।
এর একমাত্র কারণ, আমার নানা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। তার পোস্টিং ছিল চিটাগাংয়ে। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের ফ্রি টিকেট পাঠাতেন। বিনা পয়সায় যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহার কোনো মূল্য থাকে না। কাজেই সে টিকেট অধিকাংশ সময় ঘরেই পরে থাকতো। একবার কি মনে করে সবাই মিলে চিটাগাং গেলাম। অতি শৈশবের সেই চাটগাইয়া স্মৃতির তেমন কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে ঘরের পাশে একটা জানালা। জানালার পাশে পুকুর। সেই পুকুরে কোনো পানি নেই, কেবল সবুজ কচুরিপনা। এক সময় চোখ বন্ধ করলে সেই সবুজ কচুরিপানাগুলো স্পষ্ট দেখতে পেতাম। ইদানীং বয়সের কারণে সেগুলো আর দেখি না।
শেষ বয়সে এসে নানার মনে হলো, আর তিনি চিটাগাংয়ে থাকবেন না। খুলনা ফিরে আসবেন। জীবনের শেষ কটা দিন পরিবারের সাথেই কাটাবেন। মাগরিবের নামাজে বসে আল্লাহর কাছে সেই সুযোগ চাইলেন। তার দোয়ার জোর ছিল, একথা বলতেই হবে। কেননা নামাজ শেষে উঠে দাঁড়ানো মাত্র তিনি ঠাস করে পড়ে গেলেন। তার সিভিয়ার স্ট্রোক হয়েছে। তাকে ট্রেনে বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকায় নিয়ে আসা হলো। ঢাকা মেডিকেলে । প্রথম কিছুদিন তার কোনো জ্ঞান ছিল না। একদিন ডাক্তাররা সবিস্ময়ে দেখলেন, তার জ্ঞান ফিরেছে। তার বিছানার পাশে জানালা। সেই জানালার কাঁচে আঙ্গুল দিয়ে লিখেছেন, তাহীম।
আমাকে সাথে সাথে হাসপাতালে নানার পাশে হাজির করা হলো।
দীর্ঘদিন তার কোনো বাকশক্তি ছিল না।
আমার পরম সৌভাগ্য যে, নানার শেষ বয়সের দিনগুলোতে আমি তার পাশে ছিলাম। ততদিনে আমি বেশ বড় হয়ে গিয়েছি। ক্লাস থ্রিতে পড়ি। কয়েকদিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। রাতদিন উজাড় করে পড়ছি। এ সময় নানার মাথায় হালকা সমস্যা দেখা দিলো। তার নাম ছিল ফরিদুর রহমান। ঠিক করলেন, এই নাম তিনি বদলে ফেলবেন। নাম বদলে রাখলেন, শেখ ফরিদউদ্দিন। এই নাম বদলের প্রক্রিয়ার মধ্যে বাসার সবাই পড়লো। আমার বাবার নাম, শহীদ আলী। তার নাম রাখা হলো, শেখ শহীদ উদ্দিন। আমার ছোট ভাইয়ের নাম হলো শেখ প্রদীপ উদ্দিন। এমনকি আমাদের বাসায় কাজ করতো মতি মিয়া। তার নাম হয়ে গেলো শেখ মতি উদ্দিন। একই সূত্রে আমার নামও বদলে শেখ তাহীম উদ্দিন হবার কথা। কিন্তু সেটি হলো না। তিনি আমার নামে একটা লেজ জুড়ে দিলেন। নাম হলো , শেখ তাহীম উদ্দিন চাঁনপুরী।
এই শোকে আমার ছোটভাই কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো। তার নামে কোনো চাঁন বা তারাপুরী নেই- এই তার শোকের মর্মবাণী। তার দুঃখ সইতে না পেরে আমার ছোটখালা পর্যন্ত নানাকে অনুরোধ করলেন, আমার ছোট ভাইয়ের নামে যেন একটা চাঁদ কিংবা সূর্য বরাদ্দ করা হয়। নানা সেটা করলেন না। তিনি তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। চাঁদ, সূর্য, তারা তিনি আর কাউকেই দেবেন না।
সমস্যা খুবই জটিল আকার ধারণ করলো পেনশনের টাকার উঠানোর সময়। পিয়ন এসেছে পেনশনের টাকার মানি অর্ডার দিতে। নানা সাইন করলেন, শেখ ফরিদ উদ্দিন। পিয়ন তো সেই সাইন নেবে না। অথচ এই পেনশনের অল্প টাকাটার মূল্য তখন অপরিসীম। মামা, খালা মিলে আমরা সবাই নানার পাশে গোল হয়ে বসে তাকে বুঝাচ্ছি। কিছুতেই তিনি তার নাম বদলাবেন না।
অনেক অনুরোধের পর তিনি নতুন করে সাইন করতে রাজী হলেন। মানি অর্ডারের কাগজে তিনি লিখলেন, শেখ তাহীম উদ্দিন চাঁনপুরী। তারপর তার সেকী হাসি।
সবুজ কচুরিপানার উজ্জ্বল স্মৃতি এখন ফিকে হয়ে গেছে। তবু ঘুমের ঘোরে আমি নানার সেই হাসির শব্দ শুনি। দিন যতই যাচ্ছে, সেই হাসির শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
লক্ষণ মোটেও সুবিধার না।
নানাকে আমিও পাগলের মতো ভালবাসি, তবু্ও এত তাড়াতাড়ি নানার কাছে যাবার ইচ্ছে আমার মোটেও নেই।
নানা কি আবারো আমার নামধাম লিখে বসে আছি কিনা, কে জানে।
Comments
Post a Comment