মনের অগোছালো কিছু কথা।
তরুণ কবি— কথাটা কল্পনামাত্র অনেকেরই চোখে ভেসে ওঠে এমন এক গঞ্জিকাসেবী ছিঁচকে ছোকরার চেহারা, যে গোত্রহীন গাধাটি উঠতে-বসতে নারীর গলগ্রহ হয়ে থাকবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রার গায়ে মুদ্রিত 'চাহিবামাত্র ইহার বাহককে একশত টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে' বাক্যটির মতো কোনো নারী বলিবামাত্র কবিটিও ঐ নারীকে নিয়ে পদ্য রচনা করতে বাধ্য থাকবে। গত অর্ধযুগে ন্যূনতম অর্ধশত নারীর কাছ থেকে আমি কবিতা লেখার ফরমায়েশ পেয়েছি, যাদের সাথে কোনোকালে আমার দেখা হয়নি। তাদের ধারণা— ছবি দেখেই একজন নারীকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেলা সম্ভব এবং কবিরা একদিনে ডজন খানেক কবিতা লিখে ফেলতে পারেন! কবিতা ও কবি নিয়ে যুগ-যুগ ধরে চলমান এমনতর অপধারণা ও কুসংস্কারের অবসান অত্যাবশ্যক।
আমি গদ্যকবিতা লিখি না বা লিখতে পারছি না প্রায় চার বছর হলো। এই চার বছরে অন্ত্যমিল-সমৃদ্ধ বেশ কিছু চটুল ছড়া ও কতিপয় প্রেমের ছড়া লিখলেও শত চেষ্টা করেও কোনো গদ্যকবিতা লিখতে পারিনি। রাইটার্স ব্লকের জুতসই বাংলা না থাকলেও একে 'কাব্যিক খরা' বা 'কাব্যিক বন্ধ্যাত্ব' বলা যেতে পারে। আমার প্রত্যেকটি গদ্যকবিতায় কিংবা ছড়ায় একটি করে প্রচ্ছন্ন গল্প থাকে, সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক বার্তা থাকে; গদ্য-পদ্য নির্বিশেষে আমার প্রত্যেকটি লেখার শেষে উত্তেজনাকর পাঞ্চ লাইন থাকে। যেকোনো লেখা শুরু করার আগে প্রথমে আমি ঐ শেষের পাঞ্চ লাইন নির্ধারণ করি এবং পাঞ্চ লাইন ঠিক করতে না পারলে লেখাটিতে হাতই দেই না বা দিতে পারি না, লেখার প্লটটা মরে যায় ওখানেই। একটি লেখার দুটো পাঞ্চ লাইন খোঁজার জন্য স্নান-আহার বন্ধ করে কতক্ষণ ঘরের খিড়কি এঁটে ঝিমিয়েছি, এর ইয়ত্তা নেই।
আমার লেখার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনুপ্রাস। পরপর একাধিক শব্দ একই অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়াকে অনুপ্রাস বলে (যেমন : কাননে কুসুম কলি)। কবিতায় এই সামান্য দু-চারটে অনুপ্রাস অনুসন্ধানে মগজে কত-কত ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়, তারও ইয়ত্তা নেই। কবিতার অন্ত্যমিলের কথা ভাবতে-ভাবতে ফুটপাতে হাঁটার সময়ে বিপরীতদিক থেকে ধেয়ে আসা বাইকের ছোবলে আচানক আহতও হয়েছি একাধিকবার।
কবিতার প্লট পূর্বাচলের প্লটের মতো না, তেলে-তেলে তদবির করে সরকারি আবাসনপ্রকল্পের প্লট বাগানো গেলেও কবিতার প্লট জাগানো যায় না। কলেজে পড়াকালে ইংরেজি-শিক্ষক ওয়ালিউল ইসলাম উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের 'ইয়ারো আনভিজিটেড' ও 'ইয়ারো ভিজিটেড' কবিতার গল্প শুনিয়েছিলেন এখন থেকে এগারো বছর আগে, আর ঐ গল্পের সাথে নিজের জীবনের একটি ঘটনা মিলে যাওয়ার পর 'দেখা তুমি, অদেখা তুমি' নামে একটি কবিতা লিখেছি এখন থেকে ছয় বছর আগে; অর্থাৎ কবিতাটির প্লট মাথায় নিয়ে ঘুরেছি পাঁচ বছর, বলিবামাত্র-চাহিবামাত্র কবিতার প্লট তৈরি হয় না।
কবিতা এ যাবৎ যে কয়টিই লিখেছি, কারো দ্বারা আদিষ্ট হয়ে লিখিনি একটিও। আদিষ্ট বা অনুরুদ্ধ হয়ে 'কবিতার মতো কবিতা' লেখা কারো পক্ষে সম্ভব বলেও মনে করি না। অনেকেই মনে করে বসে— আমার প্রেমের কবিতাগুলোর একেকটি বুঝি একেক জনের আবদারে রচিত। হিশেব কষে দেখেছি আমার গোটা কবিতায় নয়জন নারীর উপস্থিতি আছে, যাদের কেউই আমাকে কবিতা লেখার অনুরোধ করেনি। বাংলাদেশ বেতারের মতো 'অনুরোধের আসর গানের ডালি' সাজিয়ে বসা কবির কম্ম না। আমার সাবেক একজন প্রেমিকা দেড় বছর ধরে মানসিকভাবে ব্ল্যাকমেইল করেও আমাকে দিয়ে তাকে নিয়ে একটি কবিতা লেখাতে পারেনি।
এ যাবৎ অর্ধশতাধিক নারী পেয়েছি, যারা কোনো ধরনের পূর্বপরিচয় বা পূর্বআলাপ ছাড়া নক করেই আমাকে অনুরোধ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কবিতা লিখতে! যার সাথে কখনও দেখা হয়নি, ফোনে আলাপ হয়নি, নিদেনপক্ষে ইনবক্সেও বাক্যবিনিময় হয়নি; এমন কেউ কী করে প্রথম নকেই তাকে নিয়ে কবিতা লেখার জন্য কবিকে ফরমায়েশ দিতে পারেন, তা বোঝা মুশকিল। একজন শতভাগ অচেনা পুরুষের কোনো নারীকে প্রথম নকেই সঙ্গমের আহ্বান জানানো এবং একজন শতভাগ অচেনা নারীর কোনো কবিকে প্রথম নকেই তাকে নিয়ে কবিতা লেখার আবদার জানানোর মধ্যে সবিশেষ পার্থক্য নেই। দুটোই বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত।
ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত শত-শত নারীর সাথে বইমেলায় ও মেলার বাইরে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে; নারীর সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে যে হাভাতে হাহাকার কুড়ি-একুশে আমার ছিল, এর ছিটেফোঁটাও এখন নেই; বয়সের জোয়ার-জলে ঢাকা পড়ে গেছে আমার হাহাকারের হাতিয়া দ্বীপ। তবে, যেসব অচেনা নারী তাদেরকে নিয়ে কবিতা লেখার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছে; মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের কারো সাথেই পরবর্তীতে আমার আর দেখা হয়নি, এমনকি আমি আহ্বান জানানোর পরও তাদের কেউ ইনবাকশোর তালা খুলে বেরোয়নি।
আমাকে কবিতা-লিখতে-বলা রোকেয়া হলের এক ছাত্রীকে আমি দুই দিন বার্তা পাঠিয়েছিলাম টিএসসিতে আসতে, ক্লান্তি ও কাজের দোহাই দেখিয়ে রোকেয়া হল থেকে টিএসসি পর্যন্ত একশো গজ পথ সেই ছাত্রীটি আমার জন্য পাড়ি দিতে পারেনি। অথচ এই আমারই সাথে দেখা করতে বাসে-ট্রেনে শত-শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে কোনো-কোনো নারী; কেউ টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ থেকে, কেউ চট্টগ্রাম-সিলেট-রাজশাহি থেকে। যারা শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসেছিল, তাদের কেউ আমার কাছে কবিতা চায়নি; আমার কাছে কবিতা চেয়েছে তারাই, যারা আমার জন্য শত গজও পাড়ি দিতে অনিচ্ছুক।
নিজেকে রাবীন্দ্রিক-বলে-দাবি-করা এক তরুণী আমার কাছে কবিতা চাইল একবার; ধরি, তার নাম কৃষ্ণকলি। তার কাছে যখন জানতে চাইলাম অচেনা নারীকে নিয়ে কী করে কবিতা লিখব; সে উত্তর দিয়েছিল অচেনা হাসিনা-খালেদাকে নিয়ে যেভাবে কবিতা লিখি, তাকে নিয়েও যেন সেভাবে লিখি! উত্তর শুনে আমি যারপরনাই থমকে গিয়েছিলাম এবং মূর্ছিত মেসেজটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম মহামূর্খের মতো। কৃষ্ণকলিকে যখন সাক্ষাৎ করতে বলেছি, তখন সে জানিয়েছিল কবিদেরকে সে অনিরাপদ মনে করে এবং এই অনিরাপত্তার কারণে টিএসসির খোলা প্রান্তরেও সে আমার সাথে দেখা করতে অনিচ্ছুক; যার মাধ্যমে সে আমাকে চেনে, দেখা করতে এলে নিরাপত্তার স্বার্থে সে তাকে নিয়েই আসবে! যে নারী টিএসসির উন্মুক্ত চত্বরেও একজন কবিকে অনিরাপদ মনে করে, কবির সাথে সাক্ষাৎ করতে যে নারীর নিরাপত্তাপ্রহরী লাগে; এই অনিরাপদ পৃথিবীতে সে কী করে বেঁচে আছে— তা নারীরোগ-বিশেষজ্ঞের গবেষণার উত্তম বিষয় হতে পারে বৈকি।
একবার এক তরুণী করে বসল সৌরজগতের অভিনবতম এক আবদার। মামাবাড়ির আবদার বলে যে বাগধারাটি প্রচলিত আছে, এই আবদার সেই আবদারকেও মুহূর্তে ম্লান করে দেয়। ছড়া নয়, কবিতা নয়, নয় প্রবন্ধ-নিবন্ধ; সে আবদার করে বসেছিল আস্ত একটি বই, সে চেয়েছিল তাকে যেন গোটা একটি বই উৎসর্গ করি! এই আবদার পূরণ করতে না পারার জন্য দিগ্বিদিক দুর্নাম তো আমার নামে সে ছড়িয়েছিলই, আমাকেও শুনিয়েছিল অশ্রাব্য অকথ্য কথামালা। তাকে বলা হয়নি— কবি ইঁদুর না যে, একপ্রসবে তার আট-দশটি করে বই বেরোবে। ইচ্ছে করেছিল বই-উৎসর্গের পরিবর্তে কাঁটাবন থেকে তাকে দুটো বিলেতি ইঁদুর কিনে দিতে।
কবিতা-লিখতে-বলা নারীদের মধ্যে এভাবে যাকেই আমি সাক্ষাৎ করতে বলেছি, কেউই সাক্ষাৎ করেনি। তারা কবিকে ভেবেছে শৌচাগারের শাওয়ার, কলে চাপ দিলেই যার মুখ থেকে ঝিরঝির করে কবিতা বেরিয়ে পড়বে; তারা কবিকে ভেবেছে এটিএম বুথ, যার পশ্চাৎদেশে কার্ড পাঞ্চ করলেই সম্মুখদেশ দিয়ে গলগল করে কবিতা ঠিকড়ে বেরোবে। এদের অধিকাংশেরই প্রেমিক আছে, স্বামী আছে। ঠাট্টা করে প্রায়ই বলি— কীটনাশক ও ঔষধপত্র শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন, অস্থির প্রেমিকা ও অসুখী স্ত্রীদেরকে কবিদের নাগালের বাইরে রাখুন। মনোভূমে কাব্যিকতা ও রোমান্টিকতা লালন করলেও অর্থনৈতিক অনিরাপত্তার কারণে এই অস্থির প্রেমিকা ও অসুখী স্ত্রীরা কবিদের সাথে প্রেম করতে চায় না, কবিদেরকে বিয়েও করতে চায় না। এরা প্রেমও করে ধনকুবেরদের সাথে, বিয়েও করে ধনকুবেরকে। ধনকুবেররা এদের আর্থিক নিরাপত্তা দিলেও মানসিক স্বস্তি দিতে পারে না বিধায় এরা কবিতার জন্য কবিকে ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু চায় না কপর্দকহীন কবির মুখোমুখি হতে। ন্যূনতম যে চোখাচোখি-ভাববিন
িময়-পথচলাটুকু কবিতার জন্য দরকারি, সেই সুযোগটুকুও না দিয়ে এরা চায় কবিকে দিয়ে বায়বীয়ভাবে কবিতা লেখাতে এবং পরিচিতদেরকে ঐ কবিতা দেখিয়ে যাবজ্জীবন বড়াই করতে।
পতি-নির্যাতিত এক নারী একবার আমার কাছে একটি লেখা চেয়েছিলেন। তার পতি তাকে যে-যে নির্যাতন করেছেন, এর ওপর একটি নোট লিখিয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে তিনি চিকন অঙ্কের টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও সেই লেখাটির একটি বাক্যও আমি লিখতে পারিনি। যে ব্যাপারটা আমার নিজস্ব না, সেটি মগজে ধারণ করা পদ্যে বা গদ্যে রূপ দেয়া আমার পক্ষে নেহায়েতই অসম্ভব এবং তাকে নিরাশ করে শেষতক টাকাটা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। অর্থাৎ অর্থের অদম্য প্রলোভনেও আমি আমার ইচ্ছের বিপরীতে কখনও কিছু লিখতে পারিনি। একবার এক অচেনা অর্বাচীন ছেলে আমাকে বলেছিল তার প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা লিখে দিতে! বলতে ইচ্ছা করা সত্ত্বেও তাকে আমি বলতে পারিনি যে, সে তার প্রেমিকাটির সাথে যা-যা করে, একদিনের জন্য আমাকে তা-তা করতে দিলে আমি কবিতা লিখে দিতে পারি।
একটি কবিতার জন্মপ্রক্রিয়া যারা দেখেননি, একজন কবির জরা-জর্জর জীবন যারা কাছ থেকে অনুভব করেননি, যারা জানেন না কবিতার মাত্র একটি পঙক্তি বা একটি অনুপ্রাস বা একটি মাত্রা মেলাতে গিয়ে কবির মগজের ওপর দিয়ে বয়ে যায় বেদনার কী বিকট বুলডোজার, কবিতার একটি প্লটের জন্য কবিকে অপেক্ষা করতে হয় কত লক্ষ-কোটি মোহন মুহূর্ত, কবিতার জন্য কীভাবে উৎসর্গ করে দিতে হয় আস্ত একটা মানবজনম; তাদের কাছে কবিতা নিছকই এক মামুলি মোয়া, তাদের বাড়ির কালো গাইয়ের ওলানে হাত দিলেই শাদা দুগ্ধধারার মতো কবিতা ঝরে পড়ে, তাদের দোকানে টাকায় আট মণ কবিতা পাওয়া যায়। তাদের ধারণা— একটি কবিতা কম্পোজ বা টাইপ করতে যতক্ষণ লাগে, কবিতাটি জন্ম দিতেও ঐ একই সময় লাগে!
কবি, কবিতা ও কবিতাসৃষ্টির ব্যাপারে অপধারণার যে অদ্ভুত অচলায়তন; এর অবসানের লক্ষেই এই অপ্রিয় প্রবন্ধটির অবতারণা। ফুল-ফল, লতা-পাতা, ছাল-বাকল মিলিয়ে; দু-মুঠো অন্ত্যমিলের সাথে তিন আঙ্গুলের মাথার এক চিমটি লালা মিশিয়ে কিছু-একটা লিখে শেষের দিকে কোনো নারীর নাম লিখে দিলেই ঐ নারী লেখাটিকে 'আমাকে নিয়ে লেখা কবিতা' ভেবে পরম আনন্দে আসমানে উড়তে পারেন; কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, ওটি কবিতা নয়, ওটি নিছকই কোনো চতুর শব্দজীবীর গছিয়ে দেওয়া ফুটফুটে এক ইঁদুরছানা। কবিতার জন্য সময় দরকার, অপরিকল্পিত যৌথ পথচলা দরকার; দরকার অনিয়ন্ত্রিত প্রলয়নৃত্য, অবিভক্ত তপ্ত প্রশ্বাস আর নিঃশর্ত ভ্রমণ।
পুনশ্চ : তোষামুদে-জন প্রিয় হয় সবার পৃথিবীর পরিহাসে, তোষামোদ নেই রন্ধ্রে আমার— লিখে রেখো ইতিহাসে।
Comments
Post a Comment