ছোট বেলা থেকেই আমার স্বপ্ন, বাড়ি থেকে পালাবো। কোনো একটা মায়াবতী মেয়ের হাত ধরে, দু চোখ যেদিকে যায়, চলে যাবো। গাছের তলায় সংসার পাতবো।
লাঞ্চের পর বেশ ঘুম পায়। এসময় সিগারেট খেতে নিচে নামি। অফিসের নিচেই চায়ের দোকান। ওখানে বসে ঘন্টাখানেক আড্ডা মারি। আমার সাথে থাকেন ফারহান ফুয়াদ। এ সময় তারও ঘুম পায়। তিনিও চা পান করতে চায়ের দোকানে আসেন। আমাদের দুজনের সব মিলিয়ে জনা দশেক ভক্ত আছেন। তাদের মধ্যে আট জনই নারী। ঠিক এই সময়টাতে তারা আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন।
আমরা দুজন নানা রকম চমক লাগানো কথা বলে, সেই সব নারীকুলদের মুগ্ধ করার চেষ্টা করি। আমার ধারণা ছিল, অল্প বয়সী মেয়েরা বেশ আবেগপ্রবণ হয়। দেখা গেল, ব্যাপারটা ঠিক না।
কোনো একটা মেয়েকে খুবই আগ্রহ নিয়ে গল্প বলছি। কচ্ছপের গল্প। একটা কচ্ছপ কত তুচ্ছ প্রাণী। অথচ সে বাঁচে আড়াইশো বছর। কিন্তু মানুষের মতো মহান একটি জীবের আয়ু খুবই অল্প, মাত্র ৫০/৬০ বছর। কোনো মানে হয়? কাজেই আমাদের উচিত এই স্বল্পমেয়াদী জীবনকে যথাসম্ভব স্বার্থক করে তোলা। কোনো ইচ্ছাই যেন আমাদের অপূর্ণ না থাকে।
লেকচারের এই পর্যায়ে আমি একটু দম নেই।
অধিকাংশ মেয়ের চোখে এ সময় গভীর দুঃখবোধ খেলা করে। মনে হয়, ক্ষণিকের মানবজীবন নিয়ে তারা খুবই বিচলিত।
তখন আমি বলি, তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?
তারা মাথা নাড়ে।
আমি গভীর গলায় বলে যাই, কি আছে জীবনে বলো? চলো, দু চোখ যেদিকে যায়, পালিয়ে যাই। বেড়িয়ে পড়ি। কোনো এক প্রাচীন বটবৃক্ষের নীচে সংসার পাতি। তোমার আঁচলে আমার কপাল মুছে দিও, আমি তাতেই খুশি।
এই শতভাগ উদ্দীপনামূলক বক্তব্যের পর সব কয়টি মেয়েই আমাকে বলেছে, ভাইয়া, এই বছর না। সামনে এক্সাম আছে। ইনশাআল্লাহ সামনের বছর পালাবো। আমার জন্য একটা বছর অপেক্ষা করতে পারবেন না?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। কারণ কথাটা বলার সময় তারা প্রাণপণে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে। কাজেই আমি বিরসমুখে সিগারেট ধরাই।
পাশ থেকে ফুয়াদ বলে ওঠে, তাহীম ভাইয়ের ধৈর্য্য কম। এক বছর তো দূরের কথা, উনি কারও জন্য এক সপ্তাহও অপেক্ষা করেন না। চিন্তার কিছু নেই, আমি আছি। আমি তোমার জন্য দরকার হলে দুই বছর অপেক্ষা করবো।
মাঝে মধ্যে অন্য রকম ঘটনা ঘটে। একটা মেয়েকে এই রকম মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়েছিলাম, তার ফল হয়েছে ভয়াবহ। দুই বছর নয়, মাত্র দুই দিন পরেই মেয়েটি পালিয়েছে। আমাকে কিংবা ফুয়াদকে নিয়ে নয়, তার এক ক্লাসমেটকে নিয়ে।
ফুয়াদ আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, এইসব ব্রিটিশ আমলের প্রেমের গল্প মেয়েদেরকে বইলেন না তো। এইভাবে ভক্ত ছুটে গেলে চায়ের বিল দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কথা সত্য। এই আক্রার বাজারে ভক্ত পাওয়া মহা মুশকিল। তারা যদি এভাবে পালাতে শুরু করে, তাহলে সত্যিই বিপদ।
এরপর এক নতুন ভক্ত এলো। তার নাম ঐশী। প্রতিটি মেয়েকে দেখে আমার যা মনে হয়, ঐশীকে দেখেও তাই মনে হলো। এই মেয়েটার ভেতর ''কি যেন'' আছে। আবেগ সামলাতে পারলাম না। বাড়ি পালানো বিষয়ক বক্তৃতাটি অত্যন্ত আবেগী গলায় দিয়ে বসলাম।
মেয়েটি স্তব্ধ হয়ে শুনলো। কিছু্ই বললো না। ফুয়াদ বেজায় হতাশ হয়ে সিগারেট ধরাতে চায়ের দোকানে ঝুলে থাকা লাইটারের কাছে গেলো। এই অবসরে ঐশী ফিসফিস গলায় বলল, আমি পালাবো। আমি রাজী। কবে যাবেন বলেন?
মেয়েটার গলার মধ্যে কিছু একটা ছিল। কাজেই আমার মনে হলো, এ জগৎ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব। যদিও পরে বুঝেছি , সব মেয়ের গলার মধ্যেই কিছু না কিছু থাকে। যেটা একমাত্র আমি বুঝি এবং বুঝে ধরা খাই।
এরপর ঐশীর সাথে ফোনে পালানোর পরিকল্পনা নিয়ে বিশদ আলাপ হলো। মেয়েটার মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার কোনো অভাব নেই। এটা ভালো লক্ষণ। শুধু একটি বিষয়ে খটকা লাগলো। সে বলল, আপনার মতো বিবাহিত বুড়ো ধামড়া আমার মতো একুশ বছরের একটি মেয়ের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা সত্যিই থ্রিল।
যাই হোক। কাজের সময় খটকা আসবেই। সেসব নিয়ে ভাবলে সামনে এগুনো যাবে না।
আমি অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে সবকিছু গুছাতে লাগলাম। ভয় আর টেনশনে আমার ওজন কমে গেলো। চোখ বসে গেলো গর্তে।
বিদু বলল, তোমার চেহারা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আবারো প্রেমে পড়ছো নাকি? দুদিন পর পর প্রেমে পড়ছো, তোমার টায়ার্ড লাগে না?
বিদুর কথা শুনে আমার চোখে জল আসে। অন্য কোনো বউ হলে বলতো, দুইদিন পর পর প্রেমে পড়ো, তোমার লজ্জা লাগে না? লজ্জার বদলে ''টায়ার্ড লাগে না''- এই কথা বিদুর মতো দেবীর পক্ষেই বলা সম্ভব। আমার দুই কণ্যা তাদের মাকে শুধায়, বাবার কি হয়েছে।
বিদু হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, তোর বাপ আবার প্রেমে পড়ছে। ছোটকন্যা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলে, ইশ, বাবা আবারো উপন্যাস লিখবে। ইচ্ছার নৌকা। ওয়াক, পঁচা উপন্যাস।
যাই হোক। ডেট ফাইনাল হয়েছে। শুক্রবার পালাবো। ঐশী বলল, ওইদিন ওর অফিস ছুটি, পালানোর জন্য এটাই নাকি সুবিধাজনক।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, পালাবেই যখন, অফিস ছুটি নিয়া টেনশন করছো কেন?
ঐশী উত্তর দেয় না। বলে, মনে করে প্রেশারের ওষুধ নিয়েন। পালিয়ে যেতে গিয়ে আবার মাঝপথে ক্যাকড়া মেরে গেলে মুশকিল। বয়স্ক মানুষের সাথে প্রেম করা যে কি ঝামেলা।
ওর কথা শুনে মনে হয়, যেন জীবনে কতগুলো প্রেম করেছে। অথচ আমিই তার প্রথম প্রেম।
বৃহস্পতিবার রাতে বিদুকে বললাম, অফিসের কান্ডটা দেখছো? কাল শুক্রবার, তবু অফিসে যেতে হবে। স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট। এখানে আর চাকরি করবো না। শালারা অমানুষ। শুক্রবার কেউ অফিস করে? আমার কি বউ পোলাপান নাই? কাল সকালে ডেকে দিও, দেরি করে অফিসে গেলে আরেক সমস্যা।
বিদু ডাকার আগেই ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে পড়ি। টেনশনে রাত্রে ঘুমই হয় নাই। বাথরুমে ঢুকে লুকিয়ে ঐশীকে ফোন দিলাম। ঐশী ফোন ধরলো না। আমার হাত পা কাঁপছে। আরেকবার ফোন দিলাম। নো রেসপন্স। পঞ্চম বারের মতো ফোন দেয়ার পর মেয়েটা ফোন ধরলো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কি সমস্যা?
আমি কাতর গলায় বললুম, আজকে না আমাদের পালানোর কথা। তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো? ওগো, তুমি কি ভুলে গেছো? তুমি কি পালাবে না? এতবড় দাগা আমাকে দিতে পারলে? তোমার কি হৃদয় মন বলে কিছু নেই?
আমার হাহাকারে ঐশী দ্রবীভূত হলো। অত্যন্ত কোমল গলায় বলল, জানেমন, কি বলো এসব? অবশ্যই পালাবো। তা বলে এত সকালে? শোনো লক্ষীটি। এরপর থেকে না আমরা গাছতলায় থাকবো? কাজেই আজ শেষবারের মতো বিছানায় আরাম করে ঘুমিয়ে নাও। ঠিক দশটায় আমরা পালাবো কেমন সু্ইটহার্ট? এখন মাথা ঠান্ডা করে ঘুমাও।
টিএসসি বসে আছি। ঐশীর এখানেই আসার কথা। সকাল দশটা থেকে ঠায় বসে আছি। টেনশনে গলা শুকিয়ে আসছে। একটু পর পর চা খাচ্ছি। ঐশীর দেখা নাই। দুপুর বারোটার মধ্যে ১২ কাপ চা খেয়ে ফেললাম। ঠিক তখনই ঐশী এলো।
ওকে দেখে আমার মন ভরে গেলো। রাগ করতে গিয়ে পারলাম না। ওর দুই হাতে দু্ইটা বড় লাগেজ। এর মানে হচ্ছে, পালিয়ে যাবার ব্যাপারে সে অত্যন্ত সিরিয়াস।
আমি গভীর আবেগ নিয়ে বললাম, এই ভার তোমাকে বইতে হবে না ঐশী। ব্যাগ দুইটা আমার হাতে দাও। এখন থেকে তোমার সব ভার আমার।
ব্যাগ হাতে আলগি দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। পুরাই হালকা। কাহিনী কি?
ঐশী বললো, এটা তো ''ফলস লাগেজ''। ও হিন্দি সিনেমায় দেখছে, নায়িকা পালানোর সময় লাগেজ নিয়ে পালায়। ও প্রথমেই তাই করতে চেয়েছিলো। লাগেজে নাকি কাপড়চোপড়ও ঢুকিয়ে ছিলো। কিন্তু লাগেজ খুব ভারি হয়ে যাওয়ায়, সেটা খালি করে নিয়ে এসেছে। ভার বইতে হলো না, কিন্তু পুরো ''ফিল''টা পাওয়া গেলো। আইডিয়াটা সুন্দর না?
আসেন একটা সেলফি তুলি।
আমরা দুইজন সেলফি তুললাম।
রিকশায় উঠে বসলাম। আমাদের গন্তব্য সদরঘাট। ওখান থেকে চাঁদপুরের লঞ্চে উঠবো। এত জায়গা থাকতে কেন আমরা চাঁদপুর যাচ্ছি। এর পেছনের কারণ দুইটা। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশের সব জেলায় ঐশীর আত্মীয়স্বজন আছে। একমাত্র চাঁদপুরেই কেউ নেই। কাজেই চাঁদপুর আমাদের জন্য নিরাপদ।
দ্বিতীয় কারণ, চাঁদপুরে ইলিশ সস্তা।
তৃতীয় আরেকটা কারণও আছে। সেটা হচ্ছে, চাঁদপুর অত্যন্ত হানিমুন বান্ধব জেলা। কারণ নামটার মধ্যে চাঁদ আছে।
লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার আধা ঘন্টা পর আমি আবিষ্কার করলাম, ভুল লঞ্চে উঠেছি। এটা চাঁদপুরে যাবে না, মুন্সিগঞ্জ যাবে।
রাগে দুঃখে নদীতে ঝাপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করলো। ঐশীর অবশ্য কোনো ভাবান্তর নেই। সে মহা আনন্দে টাইটানিক স্টাইলে লঞ্চের সামনে গিয়ে দু হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো লঞ্চের লোকজন অতি আনন্দ নিয়ে এই দৃশ্য দেখছে। কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে।
আর আমি ফাঁকা দু্ইটা লাগেজ নিয়ে লঞ্চের ডেকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি।
আমার মূল চিন্তা কখন এই লঞ্চ মুন্সিগঞ্জ পৌঁছাবে। ওখানে পৌঁছানোর পর দুইটা লাগেজ আর এই মেয়েটি- এই তিনটাকে নিয়ে ফিরতি লঞ্চে ঢাকায় ফিরতে হবে। বাড়ি পালানোর শখ আমার মিটে গেছে।
মুন্সিগঞ্জে নেমে ঐশীকে বললাম, পালানোর পরিকল্পনা বাতিল। চলো ঢাকা ফিরে যাই।
সাথে সাথে সে একমত পোষণ করে বলল, সেঁটাঁই ভাঁলোঁ। যাঁ রোঁদ এঁখাঁনে।
তবে মন খারাপ করবেন না। আমি আপনাকে নিয়ে অবশ্যই গাছতলায় যাবো। চলেন একটা গাছ খুঁজে বের করি।
খোদার কি ইশারা, ঘাটে কোনো গাছ নেই। কিছু ন্যাড়া গাছ আছে। কিন্তু ওগুলো ঐশীর পছন্দ না। বলে, ধ্যাত এটা কোনো গাছ হলো?
অতএব রিকশা নিয়ে গাছ খুঁজতে বের হলাম। রিকশাওয়ালা পঞ্চাশ টাকা ভাড়া চাইলো। সেটাই কবলু করে উঠে বসলাম। জাস্ট দুই মিনিট পর রিকশাওয়ালা সত্যি সত্যিই একটা গাছের সামনে রিকশা থামালো।
ঐশী অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে বলল, মামা এটা কী গাছ?
রিকশাওয়ালা বলল, বেল গাছ। নামেন। আমার ভাড়া দেন।
এটি একটি কাল্পনিক ঘটনা বাস্তবতার সাথে এর কোনো মিল নেয়।
Comments
Post a Comment