মেয়েটা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পাগলের মত কাঁদছে। উষ্কখুষ্ক চুলে তাকে এই মূহুর্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগীর মত লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হওয়ায় তার গলা দিয়ে একটু পর পর অদ্ভূত একটা আওয়াজ হচ্ছে। যে কেউ তার কান্না শুনলে ভাববে, সে একটু পর দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।
যে মানুষটার জন্য সে কাঁদছে, সে এই মূহুর্তে অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে বসে আছে। মানুষটার চোখেমুখে কোন ধরণের মায়াদয়ার ছাপ নেই। মনে হচ্ছে, সে কিছুটা বিরক্তও বটে। পশুপাখির কান্না শুনলেও মানুষের কষ্ট হওয়া উচিত, অথচ জলজ্যান্ত একটা মানুষের কান্না শুনে তার কোন কষ্ট হচ্ছে না। আচ্ছা, আসলে সে কি মানুষ ??
চারপাশের সবার মতে, সে আসলে কোন মানুষ না। সে একটা জানোয়ার। জানোয়ার ছাড়া অতটা নিষ্ঠুর, অতটা নির্দয়, অতটা পাথর কেউ হতে পারে না। পুরো পৃথিবীর মানুষ কে জিজ্ঞেস করলে তারা এক বাক্যে বলবে, এই অমানবিক নিষ্ঠুর জানোয়ারটাকে খুন করে ফেলা উচিত !!

পৃথিবীর মানুষগুলো জানে না, এই জানোয়ারটাও এক সময় মানুষ ছিলো। তীব্র আবেগ নিয়ে সেও একসময় কাঁদতে জানতো। কেউ একজন খুব যত্ন করে আবেগের দোহাই দিয়ে তার গলার ভেতর দিয়ে বিশাল একটা পাথর ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। সেই পাথরটা তার গলায় গিয়ে যখন আটকে ছিলো, তখন তার নিঃশব্দ চিৎকার পৃথিবীর কোন মানুষ শোনে নি।
মানুষটাকে ভালোবেসে তীব্র যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিলো কেউ একজন। সেই তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করার সময় মানুষটাও দাঁতে দাঁত চেপে উন্মাদের মত কেঁদেছিল। সেই কান্না পৃথিবীর কেউ শোনে নি।
খুব ছোটবেলা থেকে একটার পর একটা অসহ্য যন্ত্রণা পেতে পেতে একদিন মানুষটার চোখের সবটুকু পানি শুকিয়ে যায়। একদিন কিভাবে জানি মানুষটা ঐ পাথরটা গিলে ফেলে। বুকের ভেতরের সবটুকু জায়গা ঐ পাথরটা যখন দখল করে ফেলে, মানুষটা তখন অনুভূতিহীন অবশ।
উন্মাদের মত কাঁদতে কাঁদতে যে মানুষটা বড় হয়েছে, একটা সময় তীব্র কষ্টেও তার আর কান্না আসে না। চাইলেও সে কাঁদতে পারে না। তার চোখের পানি অনেক আগেই শুকিয়ে গিয়েছে। তার চোখে এখন শূন্যতা থাকে। শুধুই শূন্যতা থাকে।
একটা মানুষ এমনি এমনি নিষ্ঠুর হয়ে যায় না। একটা মানুষ এমনি এমনি পাথর হয়ে যায় না। পৃথিবীর সবাই যাকে আজ "জানোয়ার" বলছে, সে আসলে জানোয়ার ছিলো না। তাকে জানোয়ার বানিয়ে দেয়া হয়েছে। খুব যত্ন করে ভালোবাসা দিয়ে তিলে তিলে তাকে নিষ্ঠুর, নির্দয় আর পাথর প্রকৃতির একটা জানোয়ার বানিয়ে দেয়া হয়েছে।
দিনশেষে সিমপ্যাথিটা বরাদ্দ থাকে শুধু সেই মানুষটার জন্য যে হাউমাউ করে কাঁদতে জানে। পুরো পৃথিবীকে তার আবেগ এর খোঁজ দেখাতে জানে। যে তার কষ্টের গল্পটা সবাইকে শুনাতে জানে।
দিনশেষে ঘৃণাটুকু বরাদ্দ থাকে শুধু সেই জানোয়ারটার জন্য। যে কাঁদতে জানে না। যে পুরো পৃথিবীকে তার বুকের ভেতর পাথরচাপা আবেগ এর খোঁজ দিতে জানে না। যে তার কষ্টের গল্পটা কাউকে শুনাতে পারে না।
প্রত্যেকটা গল্পেরই দুটো পাশ থাকে। পৃথিবীর মানুষগুলো শুধু এক পাশের গল্পটা জানে। শুধু এক পাশের গল্পটাই শোনে। অন্য পাশের গল্পটা পুরো পৃথিবীর কাছে অজানা থাকে। কেউ জানতে চায় না। কেউ শুনতে চায় না। শুনলেও বিশ্বাস করতে চায় না।
 জানোয়ারকে বিশ্বাস করতে নেই। জানোয়ারকে বিশ্বাস করা নিষেধ 😊

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !