এই জন্য আমি হাজারটা পথ হেঁটেছিলাম

একেকটি সাহিত্য-আসর একেকটি পূর্ণাঙ্গ বিনোদন-ব্যবস্থা। বিবিধ বৈশিষ্ট্যের বহুবিধ কবির দেখা মেলে সাহিত্য-আসরে। কবিতা শুনতে-শুনতে একপর্যায়ে ক্লান্তি এলেও এই বর্ণাঢ্য-বিদগ্ধ কবিদের বাহারি বৈচিত্র্য দেখে বলিহারি যেতে হয়, সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নিমিষেই। এই আসরে না গেলে টের পাওয়া যায় না শিল্পিত কবিতার পেছনের কারিগরেরা কতটা লোমহর্ষক, কতটা চাঞ্চল্যকর। সাহিত্য-আসরে আগত কবিদেরকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায় তাদের চরিত্র ও বৈচিত্র্যের আলোকে।
প্রত্যেকটি সাহিত্য-আসরে থাকে একটি করে গলাভাঙা গ্রুপ। এরা মঞ্চে এসে বক্তব্য শুরু করবেন এভাবে— 'আসলে আমার ঠাণ্ডা লেগেছে, গলাটাও ভেঙে গেছে। এই গলা নিয়ে আমি আপনাদেরকে কতটা ভালো আবৃত্তি উপহার দিতে পারব, জানি না। তবুও চেষ্টা করছি।' তাদের গলা অবশ্য বারো মাসই ভাঙা থাকে এবং প্রতিটি আসরে ভাঙা গলার কথা জাতিকে তারা সযত্নে স্মরণ করিয়ে দেন। ঐ ভাঙা গলা নিয়েই তারা যে পৌনঃপুনিক পদ্যতাণ্ডবের পরিচয় দেন, তাতে গলা ভাঙা না থাকলে কী যে হতো— ভাবতেই গা-হাত-পা শিউরে ওঠে।
একটি করে তেলেগু গ্রুপ থাকে প্রতিটি আসরে। এই তেলবাজ গ্রুপটি সব কিছুতেই ধন্য বোধ করেন। এরা মঞ্চে উঠে প্রথমেই বলেন, 'আসলে কী বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। আমার সামনে এত-এত গুণী মানুষ বসে আছেন; তাদের সামনে দাঁড়াতে পেরেই নিজেকে ধন্য মনে করছি, এখানে কবিতা পড়তে পেরে আরো ধন্য বোধ করছি। সবচেয়ে বড় কথা— এখানে উপস্থিত আছেন শ্রদ্ধাভাজন মৃন্ময় মোতাহার। এই দেখুন আমার হাত-পা কাঁপছে! ওনার সামনে কবিতা পড়তে পেরে আমি ধন্য।' এরা ধন্যবাদজ্ঞাপন করেন আড়াই মিনিট, কবিতা পড়েন আধ মিনিট। মঞ্চ থেকে নামার সময়ে এদের কেউ-কেউ মৃন্ময় মোতাহারের কদমবুসিও করে থাকেন এবং কবিটি নারী হলে মোতাহার তার বাহুযুগল শক্ত করে ধরে 'এসবের কী দরকার ছিল' বলে বিনয়ে গলে পড়েন এবং কবিটি পুরুষ হলে মোতাহার ব্যস্ত থাকেন বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটাতে কিংবা মিলনায়তনের দেয়ালে ধাবমান টিকটিকির সৌন্দর্য দর্শনে।
ম্যারাথন গ্রুপের কবিরা সৌরজগতের দুঃসাহসী চিজ। একবার মাইকের দখল পেয়ে বসলে শ্রোতাদের তো খবর আছেই, খবর থাকে মাইকেরও। আসরে 'দুটোর বেশি নয়, একটি পড়লে ভালো হয়' নীতিটি প্রচলিত থাকলেও উপর্যুপরি অ-কবিতা না-কবিতা উপ-কবিতা এরা পড়তেই থাকেন। থামার জন্য চিরকুট পাঠানোর পরও তারা পড়তে থাকেন, কানে-কানে থামতে বলে এলেও তারা পড়তে থাকেন। শেষে মাইক বন্ধ করে দিয়ে থামাতে হয় তাদের কাব্যতাণ্ডব। মাইক বন্ধ করে দেওয়ার পর স্ব-আসনে ফিরে গিয়ে 'আজ ফাটিয়ে দিয়েছি' মর্মে তারা আত্মশ্লাঘা বোধ করেন।
হাইব্রিড গ্রুপও সাহিত্য-আসরে বেশ পরিচিত। আসরের পুরোটা সময়জুড়ে কাগজ-কলম নিয়ে এদেরকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী কবির সাথে অযথা বাক্যালাপের ফুরসত এদের নেই। এরা মঞ্চে উঠেই বলেন, 'এখানে আসার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, আসলে আমি জানতামই না এখানে একটি আসর হয়। আমার কবিবন্ধু আদিত্য আতাহার আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। সাথে করে কোনো কবিতা নিয়ে আসতে পারিনি। তাই এখানে বসে-বসেই আমি ছয়টি কবিতা লিখেছি এবং ঐ কবিতাগুলো এখন পড়ে শোনাব।' এরা এক বসায় ডজন-ডজন মহাকবিতার জন্ম দিতে পারেন, যা দেখে খোদ ইঁদুরও ঈর্ষার আগুনে পুড়ে মরে। ইঁদুরের পক্ষেও এক বৈঠকে এত ছানা জন্ম দেওয়া অসম্ভব।
ঝটিকা গ্রুপের কবিরাও আসরের অনিবার্য অংশ। এরা আসেন দেরিতে, কবিতা পড়তে চান আগে, আগে কবিতা পড়তে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে সঞ্চালককে করেন সন্ত্রস্ত এবং কবিতা পাঠ করেই এরা ঝটিকা মিছিলকারীদের মতো লাপাত্তা হয়ে যান। এদের পদ্যপাঠের গতি কোর্টনি ওয়ালশের ফাস্ট বোলিংয়ের গতি অপেক্ষা বেশি। খাবার খেয়েই মেজবানের বাড়ি ত্যাগ করার দুর্নাম আছে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চলের মেহমানদের। ঐ মেহমানদের সাথে ঝটিকা গ্রুপের কবিদের মিল আছে।
বিদ্রোহী গ্রুপের কবিরা ভয়োদ্দীপক। এরা যা-ই পাঠ করেন, পাঠ করেন রাজনৈতিক ভাষণের মতো করে। নিছক শিশুতোষ ছড়াও এরা এমন বাজখাঁই স্বরে পড়েন যে, এক পর্যায়ে বেচারা মাইকও বেমালুম বেহুঁশ হয়ে যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তাদের গলার রগ এখনই ছিঁড়ে যাবে, চোখ দুটো এখনই কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে, দাঁতের চোয়াল এখনই ভেঙে পড়বে এবং ফেরেশতা ইসরাফিল এখনই শিঙায় ফুঁ দেবেন। এদেরকে ভায়াগ্রা গ্রুপও বলা যেতে পারে।
আসরে আরেকটি গ্রুপ থাকে— মোমবাতি গ্রুপ। মঞ্চে উঠে এরা বিনয়ে মোমের মতো গলে যান। গুটিগুটি পায়ে মঞ্চে উঠে ঢোঁক গিলতে-গিলতে এরা মিহি স্বরে বলেন, 'শুরুতেই বলে নিচ্ছি— আমি কিন্তু কবি নই, কবিতাও লিখি না। এই টুকটাক-ছাইপাশ-হাবিজাবি লেখা-টেখার চেষ্টা-টেষ্টা করি-টরি আর কী।' কবি না হয়েও যে পরিমাণ কবিতা এরা বিশ্বসাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন, এরা কবি হলে বিশ্বসাহিত্যের দশা কী যে হতো— ভাবতেই সবশ শরীর অবশ হয়ে আসে।
রিংটোন গ্রুপটি কেবল সাহিত্য-আসরে না, সব মিটিংয়েই থাকে। মিটিংকালে এদের মিনিটে-মিনিটে কল আসবে, বিদঘুটে রিংটোন বেজে উঠবে, ফোনে দেশ-জাতি উদ্ধার করবে এবং অপর প্রান্তে থাকা পরকীয়া প্রেমিকাকে বলবে— 'আর বোলো না, নাতাশা! কবি রুদ্র রাসেল আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে এক সাহিত্য-আসরে। আমি কবিতার কী বুঝি? খ্যা খ্যা খ্যা!' এরা মঞ্চে উঠে কবিতা খুঁজে পাবেন না। না পেয়ে সবার সামনে প্যান্টের পকেট হাতাবেন, মানিব্যাগ হাতাবেন, হাতাবেন প্রকাশ্যে হাতান-অযোগ্য আরো অনেক কিছু। পরিশেষে চিরকুটটি খুঁজে পাওয়ার পর তার দিগ্বিজয়ী মুখশ্রী দেখে মনে হবে— এই বুঝি তার বড়শিতে সৌরজগতের বৃহত্তম হাঙরটি ধরে পড়েছে!
জাবর-কাটা গ্রুপও সাহিত্য-আসরে চোখে পড়বেই। মঞ্চে ডাকলে কবিতাপাঠের চেয়ে প্রধান অতিথির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে জাবর কাটতেই এরা বেশি উদগ্রীব থাকেন— 'আজকের আসরের মধ্যমণি চার্বাক চুন্নু আমার একচল্লিশ বছরের পুরোনো বন্ধু। আমরা যখন একসাথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করি, তখন এখানে উপস্থিত অনেকের জন্মও হয়নি।' নিজেদেরকে প্রবীণ ও উপস্থিত অন্যদেরকে অর্বাচীন প্রমাণের মধ্যে এরা অনুভব করেন পৈশাচিক পুলক। পদ্যপাঠকালে প্রতি পঙক্তির পরে এরা আধ মিনিট করে বিরতি নেন, যে বিরতিতে পুরো এক কাপ চা শেষ করে ফেলা সম্ভব। পদ্যপাঠের ফাঁকে-ফাঁকে চশমার ফাঁক গলে এরা শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন শ্রোতাদের দিকে, একটি নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন কে কে তার পদ্যপাঠ শুনছেন আর কে কে তার পদ্যকে থোড়াই করে টিপে যাচ্ছেন মোবাইল ফোন।
আমলা গ্রুপকে নিয়ে আয়োজকরা একটু অতিরিক্ত উদগ্রীব থাকেন। এরা উচ্চপদস্থ কোনো সরকারি কর্মকর্তা। বড় চাকরি করার পরও মানুষ এদেরকে চেনে না বলে পরিচিতি পেতে কবিতার জগতেও এরা খাবলা মারতে আসেন। এদের জমকালো পোশাক দেখে মনে হয় ইনি মঞ্চে নিশ্চয়ই কাঁপিয়ে দেবেন। বহু বিশেষণে বিশেষিত করে সঞ্চালক তাকে মঞ্চে ডাকেন, মঞ্চে উঠেই তিনি বলেন, 'শুরুতেই বলে নিচ্ছি— আমি এ ধরনের কবিতা লিখি না। আমার তিন মেয়ে— মারিয়া, ফারিয়া, সামিয়া। সকালে আমার ছোট নাতনিটা, মানে সামিয়ার ছোট মেয়েটা, আমাকে অনুরোধ করল ওকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে। শুধু ওর অনুরোধ রাখতেই এটা লিখেছি। কবিতাটি হচ্ছে— ওরে আমার চাঁদের কণা, আহ্ কী যে তোর হাসি; তুই কি জানিস তোকে আমি কত্ত ভালোবাসি?' আমলার অমর এই কবিতা পাঠের পর গোটা মিলনায়তন মুহুর্মুহু তালিতে মুখরিত হয়। তার সাথে আসা কেরানি তার অষ্টাদশ কাব্যগ্রন্থের বান্ডিল খুলে বিতরণ করতে থাকেন উপস্থিত সবার মাঝে; আসর-জুড়ে ধন্য-ধন্য রব ওঠে, অভ্যাগত শ্রোতৃবর্গ 'যাতায়াত-খরচ উসুল হলো' মর্মে আকাশে তোলেন তৃপ্তির ঢেঁকুর। বই বিতরণকালে সহাস্য সঞ্চালক মাইক্রোফোন কচলাতে-কচলাতে বলে ওঠেন, 'এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি— আমাদের শ্রদ্ধেয় উপ-সচিব স্যার গত মাসে গোয়ায় গিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে স্যার কিন্তু একটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। বেরোবে আগামী মাসে। বইয়ের নাম— গোয়াকে যেমন দেখেছি। স্যারকে আমরা কথা দিতে পারি স্যারের গোয়ার বইটি আমরা দল বেধে কিনতে যাব।' যে কথাটি কেউ জানে না, যে কথাটি কেউ জানবে না— এই সাহিত্য-আসর আয়োজনের পুরো খরচ গোপনে তিনি একাই বহন করেছেন, যার বিনিময়ে তাকে করা হয়েছে আসরটির প্রধান অতিথি।
অলঙ্কার গ্রুপও সাহিত্য-আসরে অবশ্যাম্ভাবী। দামি অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে কতিপয় ডামি কবি আসরে আসেন, এই বউ-বউ কবিরা মিলনায়তনে ঢুকতেই পারফিউমের ভুরভুরে গন্ধে গোটা মিলনায়তন মউ-মউ করে ওঠে। মৃতপ্রায় মিলনায়তনে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল্য, তন্দ্রাচ্ছন্ন পুং-কবিকুল চোখ ডলতে-ডলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ঘুম দূর করে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসতে। অলঙ্কার গ্রুপের কবিতাপাঠের সময়ে দশ দিক থেকে ক্যামেরার ক্যাঁচক্যাঁচ রব ওঠে, এই রবে হারিয়ে যায় তার পাঠের শব্দ। তিনি বাড়ি থেকে এক বা একাধিক ক্যামেরাম্যান সাথে করে নিয়ে আসেন এবং বাকি যারা ছবি তোলেন, তারা তার গুণগ্রাহী এবং পরবর্তীতে ফোনগ্রাহী। তুমি-আমি, লতা-পাতা, ছাল-বাকল, ফুল-ফল, বৃষ্টি-ঝর্না, আকাশ-পাতাল, পাহাড়-সাগর প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এরা পদ্য রচনা করে থাকেন। ধনাঢ্যদের এই স্ত্রীরা স্বামী কর্তৃক সময়বঞ্চিত হয়ে সাহিত্য-আসরে সময় কাটাতে আসেন বলে লোকমুখে শুনেছি। সোনামণিদের সোনার যত্ন, শিশুদের ঘাড়ের যত্ন, কিশোরদের গোড়ালির যত্ন প্রভৃতি বিষয়ে এদের প্রত্যেকের আট-দশটি করে বই থাকে; রান্নার মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও এদের প্রত্যেকের থাকে অর্ধডজন করে বিদগ্ধ বই।
আসরের এক কোণায় মলিন মুখে, নির্লিপ্ত নয়নে, আটপৌরে পোশাকে বসে থাকে এক করুণ কবি। তার পাশে নারী থাকে না, তার জন্য অপেক্ষারত গাড়ি থাকে না, তার গালে বড়জোর দীনহীন দাড়ি থাকে। তার ডাক পড়ে আসরের শেষ দিকে, যখন বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়েন দুই-তৃতীয়াংশ শ্রোতা। তাকে ডাকতে সঞ্চালক কোনো বিশেষণ ব্যবহার করেন না, ব্যবহার করেন শুধুই বিশেষ্য। তার কবিতাপাঠকালে কেউ ছবি তোলেন না, তার কবিতা কেউ রেকর্ড করেন না, তাকে কেউ ভিডিও করেন না। আনস্মার্ট এই কবির স্মার্টফোন থাকে না। মঞ্চে উঠে তিনি গৌরচন্দ্রিকা করেন না, নতমুখে কুড়ি লাইনের একটি কবিতা পড়ে তিনি নতমুখেই ফিরে যান পেছনের চেয়ারে। তার কবিতা শুনে কারো-কারো পিলে চমকে ওঠে, কারো-কারো কলজে ধক করে ওঠে— হ্যাঁ, এই কবিতাটি শুনব বলেই আমি এতক্ষণ ধরে এই সাহিত্য-সার্কাসে এত বীভৎস ভাঁড়ামো সহ্য করছিলাম, এই কবিতাটি শুনব বলেই জীবনানন্দের পিছু-পিছু আমি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছিলাম!

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !