জনজাল
একটি দেশে যেকোনো শক্তিকে টিকে থাকতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন জনসমর্থন। জনগণের একটি অংশের সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার যেমন টিকতে পারে না, তেমনি টিকতে পারে না এমনকি কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীও। পৃথিবীর যেকোনো জঙ্গিসংগঠনের ঠিকুজি খুঁজলে দেখা যাবে সংগঠনটির ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণের একাংশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন আছে, নিদেনপক্ষে 'সফট কর্নার' আছে। স্বীকার করা হোক বা না হোক, তিক্ত সত্য হচ্ছে জঙ্গিদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় অংশের নীরব সমর্থন আছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের এই নীরবতাকে পুঁজি করেই জঙ্গিরা বাংলাদেশকে বাংলাস্তানে পরিণত করার সুযোগ পেল। বাংলাদেশ একদিন বাংলাস্তানে পরিণত হবে বলে যে আশঙ্কাটি শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষেরা করে আসছিলেন এত দিন ধরে, সেই আশঙ্কা সত্য হয়েছে এবং গত পহেলা জুলাই রাত নয়টা থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাস্তানে পা রেখেছে। 'বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো' বাগধারাটি মুসলমান বাঙালিদের জন্যই বোধহয় রচিত হয়েছিল। তারা জানেনই না কখন প্রতিবাদ করতে হবে, কখন নীরব থাকতে হবে। মুসলমান বাঙালিদের অ-সময়োচিত নীরবতাই বাংলাদেশের বাংলাস্তান হওয়ার পেছনে বহুলাংশে দায়ী।
আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের নজিরবিহীন নৃশংসতার পর গোটা বাংলাদেশ যখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, ধর্ম-নির্বিশেষে অন্তর্জালে সবাই যখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে; প্রতিবাদের পিদিমের তেল হঠাৎই কমে গেল, যখন জানা গেল কোরানপাঠে সক্ষমদেরকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিয়েছে এবং সেহরি খেতে দিয়েছে। সেহরিতত্ত্ব আবিষ্কারের সাথে-সাথেই জঙ্গিদের ওপর মুসলমান বাঙালিদের একাংশ আর্দ্র হয়ে গেল, প্রতিবাদের সলতেটা দপ করে নিভে গেল। একজন শিশুও এটি বুঝবে যে, এই সেহরি-নাটকটি সাজানো হয়েছে গোটা ঘটনাটির ওপর একটি ধর্মীয় প্রলেপ দিতে এবং জঙ্গিদের প্রতি দেশের ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু কিংবা ধর্মান্ধ মানুষদের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে। এই নাটকে জঙ্গিরা শতভাগ সফলও হয়েছে; বিভ্রান্ত মুসলমান বাঙালি প্রতিবাদে ইস্তফা দিয়ে উলটো ঝাঁপিয়ে পড়েছে জঙ্গিদের মৃতদেহে 'ভালোবাসা' স্প্রে করতে, জঙ্গিদের ওপর 'ক্রাশ' খেতে। মুসলমান বাঙালির কাছে বাইশটি লাশের চেয়ে রক্তে ভাসমান একপ্লেট সেহরি অধিক মূল্যবান!
বাংলাদেশে যখনই ধর্মের নামে নরহত্যা হয়, মুসলমান বাঙালিরা 'খুনিরা সত্যিকারের মুসলমান নয়' বাক্যটি দিয়ে গোটা ব্যাপারটিকে সেকেন্ডের মধ্যে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন এবং অমুসলিম-হত্যার আনন্দে মনে-মনে খুশিই হন, মনে-মনে হত্যাকারীর পিঠ চাপড়ে দিতেও ভোলেন না। কিন্তু হত্যাকাণ্ড যখন মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা থেকে ইদগা পর্যন্ত পৌঁছল; তখনই মুসলমান বাঙালির কানে পানি ঢুকল, মুসলমান বাঙালি বুঝতে পারল— তরবারি নেহায়েতই ধর্মনিরপেক্ষ, তরবারি ধর্ম চেনে না, চেনে কেবল গর্দান। অবশ্য ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, লোকালয়ের আগুন দেবালয়ে ঢুকে পড়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামভিত্তিক সংগঠনগুলো ইসলামকে কাজে লাগিয়ে চলছে ক্ষমতার হালুয়া-রুটি বাগানোর কাজে, ধর্মরক্ষার কোনো কাজে এই সংগঠনগুলোকে কোনোকালে দেখা যায়নি। আমেরিকায় 'ইনোসেন্স অব দ্য মুসলিমস' নামক তৃতীয় শ্রেণির একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার পর ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে ইসলামজীবী সংগঠনগুলো যে তাণ্ডব দেখিয়েছিল, তা শিউরে ওঠার মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ-আন্দোলনকে প্রতিহত করতে যে তেরোটি উদ্ভট দাবি নিয়ে মতিঝিলকে নরকে পরিণত করেছিল 'হেফাজতে ইসলাম', হেফাজতের কোনো নেতাকে এখন জিজ্ঞেস করলে সেই তেরো দফার তিনটে দফাও মুখস্থ বলতে পারবেন কি না— সন্দেহ আছে। সানি লিয়ন নামক একটি পতিতার বাংলাদেশে আগমন নিয়েও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন, তারা বলেছিলেন 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও' সানি লিয়নের বাংলাদেশ-যাত্রা তারা প্রতিহত করবেন! খুব বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকার একটি তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব চালালেও মদিনায় খোদ নবিজির (সা.) মসজিদের পাশে জঙ্গিহামলার ব্যাপারে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা অবিশ্বাস্য রকমের নীরব, শাহবাগকে টেক্কা দেওয়ার জন্য লাখো মাদ্রাসা-ছাত্রক
ে মতিঝিলে জড়ো করতে পারলেও আইএসের খোদ কাবাঘর ধ্বংসের ঘোষণা শুনেও তারা অকল্পনীয় রকমের নিষ্ক্রিয়; ফেসবুকের কোণায়-কাঞ্চিতে কে কীভাবে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলো সে ব্যাপারে সোচ্চার হলেও ইদ জামাতে হামলার ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, লংমার্চ নেই, নেই 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু' দিয়ে ইদগা বা কাবাঘর রক্ষার সংকল্প!
'জঙ্গিরা সত্যিকারের মুসলমান না' বলেই বাংলাদেশের সত্যিকারের মুসলমানরা ক্ষান্ত। বাংলাদেশের 'সত্যিকারের মুসলমান'রা কখনোই এই 'মিথ্যাকারের মুসলমান'দের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি, ইদগায় জঙ্গিহামলার পর বাংলাদেশের কোনো মুসলমান 'আমার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে' কথাটি উচ্চারণ করেননি, কোনো আলেম জঙ্গিদেরকে তাগুত বা মুরতাদ বলে আখ্যা দেননি, ইদগায় হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কোনো ইসলামভিত্তিক সংগঠন মতিঝিলে লংমার্চের ডাক দেয়নি, হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে জুমার পরে বায়তুল মোকাররমের উত্তর বা দক্ষিণ গেটে হয়নি কোনো সমাবেশ, মসজিদে নববির পাশে 'মিথ্যাকারের মুসলমান'দের আত্মঘাতী হামলার পর প্রেস ক্লাবে দেখা যায়নি 'সত্যিকারের মুসলমান'দের মানববন্ধন। পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখকদের গল্প-কবিতা অপসারণে বাংলার মুসলমানরা মুক্তাঙ্গনে রগ ফুলিয়ে 'নারায়ে তাকবির' ধ্বনি তোলে, প্রধান বিচারপতির পদ থেকে হিন্দু সুরেন্দ্র কুমারকে সরাতে বাংলার 'তৌহিদি জনতা' কদম ফোয়ারায় বেদম মিছিল করে; ইদের জামাতে হামলার ঘটনায় বাংলার মুসলমান বের করে না একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য মিছিল কিংবা আয়োজন করে না একটি নাতিদীর্ঘ মানববন্ধন। সানির আগমন ঠেকাতে 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু' ঢালার ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশের মুসলমান কাবাঘর-ধ্বংস ঠেকাতে একফোঁটা ঘাম ঢালার ঘোষণাও আজ অবধি দেয়নি।
গত পহেলা জুলাই বাংলাদেশ একটি অঘোষিত যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। ব্লগার-শিক্ষক-বাউল-পুরোহিত হত্যা করে হাত পাকিয়ে জঙ্গিরা এবার হাত দিয়েছে নির্বিচার নরহত্যায়, তাদের কবল হতে এখন থেকে আর কেউ নিরাপদ থাকল না। এই অদ্ভুত যুদ্ধে মারা যেতে পারেন ভিখিরি থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত। জঙ্গিবাদবিরোধী এই লড়াইটি প্রধানমন্ত্রীর একার নয়, নয় কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও। যারা নিজেদেরকে 'সত্যিকারের মুসলমান' বলে দাবি করেন, এই লড়াইটি তাদের প্রত্যেকের; এ লড়াইটি বাংলাদেশের মুসলমান-অমুসলমান সব নাগরিকের। জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বে থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে মসজিদের ইমামদেরকে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষদেরকে, ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদেরকে, বিভিন্ন অঞ্চলের পির সাহেবদেরকে। জঙ্গিরা সুনির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের না হলেও প্রত্যেক জঙ্গিই কট্টর ইসলামপন্থি— সেই ইসলাম সত্যিকারেরই হোক, আর মিথ্যাকারেরই হোক। এ-কথাও মেনে নিতে হবে যে, জঙ্গিরা যে বিশ্বাসটা ধারণ করে, সেই বিশ্বাসের খাতিরে তারা জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। স্বার্থের জন্য না; তারা জীবন দিতে প্রস্তুত কেবল বিশ্বাসের জন্য, কেবল বেহেশতের জন্য। বেহেশতের সাথে ধর্ম জড়িত। আত্মঘাতী হয়ে, নরহত্যা করে যে বেহেশত পাওয়া যাবে না— এই কথাটি শেখ হাসিনা প্রতিদিন এক লক্ষবার করে বললেও কিংবা পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রতিদিন এক কোটিবার করে আওড়ালেও মানুষ তা একটিবারও কানে তুলবে না। ইমাম যখন জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজের আগে মসজিদভর্তি মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ানে বলবেন— আপনার সন্তানকে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখুন, তখন এই উক্তি মানুষ কানে তুলবে; মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যখন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীকে জঙ্গিবাদের কুফল সম্পর্কে অবগত করবেন, তখন মানুষ তাতে কর্ণপাত করবে; পির সাহেবরা যখন তাদের মুরিদদেরকে বলবেন— মানুষ মেরে জান্নাত জুটবে না, তখন মানুষের বোধোদয় হবে; ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা যখন সুরে-সুরে বলবেন— নিহত জঙ্গিদের জানাজা এই বাংলার জমিনে হবে না, জঙ্গিরা মুরতাদ; যে ইমাম জঙ্গিদের জানাজা পড়াবেন, তিনিও মুরতাদ; তখন জঙ্গিদের কানে পানি ঢুকবে। ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো যদি জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে দেশব্যাপী লংমার্চ-মিছিল-মিটিং করে, তা হলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আদৌ অস্তিত্ব থাকবে না। যে দুর্যোগটির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্ম জড়িত, সেই দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাগ্রে তৎপর হতে হবে ধর্মীয় নেতাদেরকেই। রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের সমীহ আছে, শ্রদ্ধা নেই। তাদের ভাষণে মানুষ কর্ণপাত করে না, তাদের মৃত্যুতে অশ্রুপাত করে না; আলেমদের বয়ানে মানুষ কর্ণপাত করে, দেশকে বাঁচাতে আগে আলেমদের মনই জঙ্গিবাদের ভূতমুক্ত হতে হবে, তাদের মুখ থেকেই বেরোতে হবে জঙ্গিবিরোধী বয়ান।
ধর্মীয় দুর্যোগে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা ও 'সত্যিকারের মুসলমান'রা নজিরবিহীন রকমের নীরব। ইদগা আক্রান্ত হওয়ার পরও, কাবাঘর আক্রান্ত হওয়ার হুমকি আসার পরও নারকীয় নীরবতাই বলে দেয় চলমান নরহত্যার প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ 'সত্যিকারের মুসলমান'দের পরোক্ষ সমর্থন আছে, হৃদয়ের বাম অলিন্দে আছে জঙ্গিদের জন্য মোহন মহব্বত, ডান অলিন্দে প্রগাঢ় পেয়ার। ধর্মীয় নেতাদের ভুলে গেলে চলবে না এই সিরিয়াল কিলিং থেকে রক্ষা পাননি নুরুল ইসলাম ফারুকির মতো আলেমও, কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশী আলেমদেরকে হত্যা করে দেশ চালাবে বিদেশী খলিফারাই। যে তরুণীদের পরানের গহিন ভেতরে জেল্লাদার জঙ্গিদের জন্য লালিত রয়েছে কুসুমিত কোমল ক্রাশ; তাদের ভুলে গেলে চলবে না জঙ্গিরাষ্ট্রে তাদের ভূমিকা হবে শুধুই যৌনদাসীর, ব্যবহার শেষে জঙ্গিরা তাদেরকে বিক্রি করবে বাজারে তুলে, যেভাবে গাবতলিতে বিক্রি হয় গবাদি গরু।
এ লড়াই একাত্তরের চেয়েও কঠিন। একাত্তরে শত্রু-মোকাবেলায় সশস্ত্র হওয়ার সুযোগ ছিল, সুযোগ ছিল মরার আগে মারার। এখনকার লড়াইয়ে সশস্ত্র হওয়ার সুযোগ নেই, এ লড়াই লড়তে হবে খালিহাতেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি হয় ষোলো কোটি, জঙ্গি যদি হয় এক লাখে একজন; তা হলে মোট জঙ্গি ষোলো শত। এক জঙ্গির কাছে লাখো জনতা জিম্মি থাকতে পারে না, ষোলো শতর কাছে জিম্মি থাকতে পারে না ষোলো কোটির বাংলাদেশ। যদি জনতা জাগে, পরাজয় ওদের হবেই। জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই শুরু হোক নিজ-নিজ ঘর থেকে; আজ, এখনই।
আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের নজিরবিহীন নৃশংসতার পর গোটা বাংলাদেশ যখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, ধর্ম-নির্বিশেষে অন্তর্জালে সবাই যখন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে; প্রতিবাদের পিদিমের তেল হঠাৎই কমে গেল, যখন জানা গেল কোরানপাঠে সক্ষমদেরকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিয়েছে এবং সেহরি খেতে দিয়েছে। সেহরিতত্ত্ব আবিষ্কারের সাথে-সাথেই জঙ্গিদের ওপর মুসলমান বাঙালিদের একাংশ আর্দ্র হয়ে গেল, প্রতিবাদের সলতেটা দপ করে নিভে গেল। একজন শিশুও এটি বুঝবে যে, এই সেহরি-নাটকটি সাজানো হয়েছে গোটা ঘটনাটির ওপর একটি ধর্মীয় প্রলেপ দিতে এবং জঙ্গিদের প্রতি দেশের ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু কিংবা ধর্মান্ধ মানুষদের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে। এই নাটকে জঙ্গিরা শতভাগ সফলও হয়েছে; বিভ্রান্ত মুসলমান বাঙালি প্রতিবাদে ইস্তফা দিয়ে উলটো ঝাঁপিয়ে পড়েছে জঙ্গিদের মৃতদেহে 'ভালোবাসা' স্প্রে করতে, জঙ্গিদের ওপর 'ক্রাশ' খেতে। মুসলমান বাঙালির কাছে বাইশটি লাশের চেয়ে রক্তে ভাসমান একপ্লেট সেহরি অধিক মূল্যবান!
বাংলাদেশে যখনই ধর্মের নামে নরহত্যা হয়, মুসলমান বাঙালিরা 'খুনিরা সত্যিকারের মুসলমান নয়' বাক্যটি দিয়ে গোটা ব্যাপারটিকে সেকেন্ডের মধ্যে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন এবং অমুসলিম-হত্যার আনন্দে মনে-মনে খুশিই হন, মনে-মনে হত্যাকারীর পিঠ চাপড়ে দিতেও ভোলেন না। কিন্তু হত্যাকাণ্ড যখন মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা থেকে ইদগা পর্যন্ত পৌঁছল; তখনই মুসলমান বাঙালির কানে পানি ঢুকল, মুসলমান বাঙালি বুঝতে পারল— তরবারি নেহায়েতই ধর্মনিরপেক্ষ, তরবারি ধর্ম চেনে না, চেনে কেবল গর্দান। অবশ্য ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, লোকালয়ের আগুন দেবালয়ে ঢুকে পড়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামভিত্তিক সংগঠনগুলো ইসলামকে কাজে লাগিয়ে চলছে ক্ষমতার হালুয়া-রুটি বাগানোর কাজে, ধর্মরক্ষার কোনো কাজে এই সংগঠনগুলোকে কোনোকালে দেখা যায়নি। আমেরিকায় 'ইনোসেন্স অব দ্য মুসলিমস' নামক তৃতীয় শ্রেণির একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ার পর ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে ইসলামজীবী সংগঠনগুলো যে তাণ্ডব দেখিয়েছিল, তা শিউরে ওঠার মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ-আন্দোলনকে প্রতিহত করতে যে তেরোটি উদ্ভট দাবি নিয়ে মতিঝিলকে নরকে পরিণত করেছিল 'হেফাজতে ইসলাম', হেফাজতের কোনো নেতাকে এখন জিজ্ঞেস করলে সেই তেরো দফার তিনটে দফাও মুখস্থ বলতে পারবেন কি না— সন্দেহ আছে। সানি লিয়ন নামক একটি পতিতার বাংলাদেশে আগমন নিয়েও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছিল ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন, তারা বলেছিলেন 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও' সানি লিয়নের বাংলাদেশ-যাত্রা তারা প্রতিহত করবেন! খুব বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকার একটি তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে তাণ্ডব চালালেও মদিনায় খোদ নবিজির (সা.) মসজিদের পাশে জঙ্গিহামলার ব্যাপারে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা অবিশ্বাস্য রকমের নীরব, শাহবাগকে টেক্কা দেওয়ার জন্য লাখো মাদ্রাসা-ছাত্রক
ে মতিঝিলে জড়ো করতে পারলেও আইএসের খোদ কাবাঘর ধ্বংসের ঘোষণা শুনেও তারা অকল্পনীয় রকমের নিষ্ক্রিয়; ফেসবুকের কোণায়-কাঞ্চিতে কে কীভাবে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলো সে ব্যাপারে সোচ্চার হলেও ইদ জামাতে হামলার ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, লংমার্চ নেই, নেই 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু' দিয়ে ইদগা বা কাবাঘর রক্ষার সংকল্প!
'জঙ্গিরা সত্যিকারের মুসলমান না' বলেই বাংলাদেশের সত্যিকারের মুসলমানরা ক্ষান্ত। বাংলাদেশের 'সত্যিকারের মুসলমান'রা কখনোই এই 'মিথ্যাকারের মুসলমান'দের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি, ইদগায় জঙ্গিহামলার পর বাংলাদেশের কোনো মুসলমান 'আমার ধর্মানুভূতি আহত হয়েছে' কথাটি উচ্চারণ করেননি, কোনো আলেম জঙ্গিদেরকে তাগুত বা মুরতাদ বলে আখ্যা দেননি, ইদগায় হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কোনো ইসলামভিত্তিক সংগঠন মতিঝিলে লংমার্চের ডাক দেয়নি, হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে জুমার পরে বায়তুল মোকাররমের উত্তর বা দক্ষিণ গেটে হয়নি কোনো সমাবেশ, মসজিদে নববির পাশে 'মিথ্যাকারের মুসলমান'দের আত্মঘাতী হামলার পর প্রেস ক্লাবে দেখা যায়নি 'সত্যিকারের মুসলমান'দের মানববন্ধন। পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখকদের গল্প-কবিতা অপসারণে বাংলার মুসলমানরা মুক্তাঙ্গনে রগ ফুলিয়ে 'নারায়ে তাকবির' ধ্বনি তোলে, প্রধান বিচারপতির পদ থেকে হিন্দু সুরেন্দ্র কুমারকে সরাতে বাংলার 'তৌহিদি জনতা' কদম ফোয়ারায় বেদম মিছিল করে; ইদের জামাতে হামলার ঘটনায় বাংলার মুসলমান বের করে না একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য মিছিল কিংবা আয়োজন করে না একটি নাতিদীর্ঘ মানববন্ধন। সানির আগমন ঠেকাতে 'বুকের শেষ রক্তবিন্দু' ঢালার ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশের মুসলমান কাবাঘর-ধ্বংস ঠেকাতে একফোঁটা ঘাম ঢালার ঘোষণাও আজ অবধি দেয়নি।
গত পহেলা জুলাই বাংলাদেশ একটি অঘোষিত যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। ব্লগার-শিক্ষক-বাউল-পুরোহিত হত্যা করে হাত পাকিয়ে জঙ্গিরা এবার হাত দিয়েছে নির্বিচার নরহত্যায়, তাদের কবল হতে এখন থেকে আর কেউ নিরাপদ থাকল না। এই অদ্ভুত যুদ্ধে মারা যেতে পারেন ভিখিরি থেকে রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত। জঙ্গিবাদবিরোধী এই লড়াইটি প্রধানমন্ত্রীর একার নয়, নয় কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও। যারা নিজেদেরকে 'সত্যিকারের মুসলমান' বলে দাবি করেন, এই লড়াইটি তাদের প্রত্যেকের; এ লড়াইটি বাংলাদেশের মুসলমান-অমুসলমান সব নাগরিকের। জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বে থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে মসজিদের ইমামদেরকে, মাদ্রাসার অধ্যক্ষদেরকে, ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদেরকে, বিভিন্ন অঞ্চলের পির সাহেবদেরকে। জঙ্গিরা সুনির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের না হলেও প্রত্যেক জঙ্গিই কট্টর ইসলামপন্থি— সেই ইসলাম সত্যিকারেরই হোক, আর মিথ্যাকারেরই হোক। এ-কথাও মেনে নিতে হবে যে, জঙ্গিরা যে বিশ্বাসটা ধারণ করে, সেই বিশ্বাসের খাতিরে তারা জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। স্বার্থের জন্য না; তারা জীবন দিতে প্রস্তুত কেবল বিশ্বাসের জন্য, কেবল বেহেশতের জন্য। বেহেশতের সাথে ধর্ম জড়িত। আত্মঘাতী হয়ে, নরহত্যা করে যে বেহেশত পাওয়া যাবে না— এই কথাটি শেখ হাসিনা প্রতিদিন এক লক্ষবার করে বললেও কিংবা পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রতিদিন এক কোটিবার করে আওড়ালেও মানুষ তা একটিবারও কানে তুলবে না। ইমাম যখন জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজের আগে মসজিদভর্তি মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ানে বলবেন— আপনার সন্তানকে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে রাখুন, তখন এই উক্তি মানুষ কানে তুলবে; মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যখন শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীকে জঙ্গিবাদের কুফল সম্পর্কে অবগত করবেন, তখন মানুষ তাতে কর্ণপাত করবে; পির সাহেবরা যখন তাদের মুরিদদেরকে বলবেন— মানুষ মেরে জান্নাত জুটবে না, তখন মানুষের বোধোদয় হবে; ওয়াজ মাহফিলের বক্তারা যখন সুরে-সুরে বলবেন— নিহত জঙ্গিদের জানাজা এই বাংলার জমিনে হবে না, জঙ্গিরা মুরতাদ; যে ইমাম জঙ্গিদের জানাজা পড়াবেন, তিনিও মুরতাদ; তখন জঙ্গিদের কানে পানি ঢুকবে। ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো যদি জঙ্গিদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে দেশব্যাপী লংমার্চ-মিছিল-মিটিং করে, তা হলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আদৌ অস্তিত্ব থাকবে না। যে দুর্যোগটির সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্ম জড়িত, সেই দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাগ্রে তৎপর হতে হবে ধর্মীয় নেতাদেরকেই। রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের সমীহ আছে, শ্রদ্ধা নেই। তাদের ভাষণে মানুষ কর্ণপাত করে না, তাদের মৃত্যুতে অশ্রুপাত করে না; আলেমদের বয়ানে মানুষ কর্ণপাত করে, দেশকে বাঁচাতে আগে আলেমদের মনই জঙ্গিবাদের ভূতমুক্ত হতে হবে, তাদের মুখ থেকেই বেরোতে হবে জঙ্গিবিরোধী বয়ান।
ধর্মীয় দুর্যোগে বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতারা ও 'সত্যিকারের মুসলমান'রা নজিরবিহীন রকমের নীরব। ইদগা আক্রান্ত হওয়ার পরও, কাবাঘর আক্রান্ত হওয়ার হুমকি আসার পরও নারকীয় নীরবতাই বলে দেয় চলমান নরহত্যার প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ 'সত্যিকারের মুসলমান'দের পরোক্ষ সমর্থন আছে, হৃদয়ের বাম অলিন্দে আছে জঙ্গিদের জন্য মোহন মহব্বত, ডান অলিন্দে প্রগাঢ় পেয়ার। ধর্মীয় নেতাদের ভুলে গেলে চলবে না এই সিরিয়াল কিলিং থেকে রক্ষা পাননি নুরুল ইসলাম ফারুকির মতো আলেমও, কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশী আলেমদেরকে হত্যা করে দেশ চালাবে বিদেশী খলিফারাই। যে তরুণীদের পরানের গহিন ভেতরে জেল্লাদার জঙ্গিদের জন্য লালিত রয়েছে কুসুমিত কোমল ক্রাশ; তাদের ভুলে গেলে চলবে না জঙ্গিরাষ্ট্রে তাদের ভূমিকা হবে শুধুই যৌনদাসীর, ব্যবহার শেষে জঙ্গিরা তাদেরকে বিক্রি করবে বাজারে তুলে, যেভাবে গাবতলিতে বিক্রি হয় গবাদি গরু।
এ লড়াই একাত্তরের চেয়েও কঠিন। একাত্তরে শত্রু-মোকাবেলায় সশস্ত্র হওয়ার সুযোগ ছিল, সুযোগ ছিল মরার আগে মারার। এখনকার লড়াইয়ে সশস্ত্র হওয়ার সুযোগ নেই, এ লড়াই লড়তে হবে খালিহাতেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি হয় ষোলো কোটি, জঙ্গি যদি হয় এক লাখে একজন; তা হলে মোট জঙ্গি ষোলো শত। এক জঙ্গির কাছে লাখো জনতা জিম্মি থাকতে পারে না, ষোলো শতর কাছে জিম্মি থাকতে পারে না ষোলো কোটির বাংলাদেশ। যদি জনতা জাগে, পরাজয় ওদের হবেই। জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই শুরু হোক নিজ-নিজ ঘর থেকে; আজ, এখনই।
Comments
Post a Comment