ফেরা-০১
আমাদের বাসার সবাই পাগল। আমার বাবা-মা পাগল। দাদা এবং দিদা পাগল। এমনকি আমাদের বাসায় যে কাজের বুয়া কাজ করে তার নাম নয়নের মা। তার মাথায়ও ভীষণ গোলমাল আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
কোন পাগলের কথা দিয়ে গল্প শুরু করব? সবচেয়ে বড় সিনিয়র পাগলের কথাই আগে বলি। তারপর বয়সের ক্রম অনুযায়ী আগানো যাবে। কেমন? আমার দাদা মোবারক আলী এই বয়সের প্রবীণতম মানুষ। উনার বয়স ৭৯। কয়েক বছর ধরে তিনি ঘটা করে নিজের জন্মদিন পালন করছেন। উনার জন্মতারিখ কবে, এটা কিন্তু উনি জানেন না। পুরনো দিনের লোকেরা কোনো রকমে জন্মসাল মনে রাখতেন ঠিকই, কিন্তু দিন তারিখের অত হিসাব রাখতেন না। তবে আমার দাদার কেসটা একটু ভিন্ন। উনি দাবি করেছেন, উনার শৈশবের স্মৃতি একদম স্পষ্টভাবে ফিরে আসছে। এমনকি জন্মের সময়কার স্মৃতিও উনি আশ্চর্যভাবে মনে করতে পারছেন।
আমাদেরন বিজ্ঞান ক্লাসের স্যার বলেছেন, মানুষ নাকি তার শৈশবের ৩বছরের আগের স্মৃতি মনে করতে পারে না। আমার দাদা পারছেন। তাও বুড়ো বয়সে এসে।
দাদার স্মৃতি অনুসারে, উনার জন্মের সময় বেশ শীত পড়েছিল। এমনকি ঘন কুয়াশাও হয়েছিল, এটাও উনার স্পষ্ট মনে আছে। শীত এবং কুয়াশা মোতাবেক উনার জন্ম ডিসেম্বরের ১২তারিখ। তখন আমরা তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, শীত এবং কুয়াশা মোতাবেক উনার জন্ম ডিসেম্বরের ১২ তারিখ।
তখন আমরা তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, শীত তো ডিসেম্বর থেকে ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকে। উনি কীভাবে বুঝলেন ওটা ডিসেম্বরের ১২তারিখই? এই প্রশ্নে উনি খেপে যান। বলেন, বেশি দিগদারি করিস না। দিগদারি শব্দটা মানিকগঞ্জের। এটার অর্থ কী- আমি জানি না। তবে দাদা প্রায়ই এই শব্দটা ব্যবহার করেন। কী কথা যেন বলছিলাম?
ও হ্যাঁ, আমার দাদার কথা। আমার দাদার পাগলামির কথা। একটা নমুনা দিই। আজ শুক্রুবার বলে স্কুল বন্ধ। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই কিছু ভালো লাগছিল না। ওদিকে টিভির রিমোটও খুঁজে পাচ্ছি না। সারা বাসা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কোথাও রিমট নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসার সবার মাথা খারাপ হয়ে গেলো। সবাই রিমোট খোঁজা শুরু করল। যেন রিমোট না পেলে একনই পুরো বাড়ির ছাদ মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়বে। সবচেয়ে বেশি ব্যাকুলতা দেখা গেলো আমার বাবার মধ্যে। তিনি বললেন, বাসায় কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। একটা সিম্পিল রিমোট কেন কাজের সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা জবাবদিহি বিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিবারে বাস করছি আমরা। কথা বলার সময় আমার বাবা খুব কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি টিভিতে টক শো উপস্থাপনা করেন তো এইজন্যই উনার কথাবার্তা এমন হয়ে গেছে।
যাইহোক, গোটা বাসার এই উত্তেজনার মধ্যে একমাত্র দাদাকেই দেখা গেল অবিচলিত, নির্ভার এবং নির্বিকার। তিনি মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ উলটাচ্ছেন। মাঝখানে একবার মাথা উঠিয়ে বললেন, কই রে নয়নের মা, এক কাপ চা দিবা নাকি?
এই কথায় নয়নের মা মা ফুঁসে উঠল- এইটা কী কইলেন খালুজান। ঘরের মধ্যে এত বড় বিপদ, টিভির রিমুট পাওয়া যাইতাছে না, এর মধ্যে আপনি চা চান ক্যামনে? আমার দাদা পুনর্বার খবরের কাগজে ডুব দিলেন। আর তখনই আমার দুম করে মনে পড়ল-আজ তো বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলক। নিউজিল্যান্ডের সাথে। বাংলাদেশের সব মানুষ ক্রিকেটের পাগল। যেহেতু আমাদের বাড়ির সবার মাথা খারাপ, কাজেই এই বাসার কেউ ক্রিকেট খেলা দেখে না। টিভিতে যখন ক্রিকেট খেলা হয়, তখন আমাদের বাসার টিভিতে চলে হিন্দি সিরিয়াল কিংবা টক শো চলে। একমাত্র ব্যতাক্রম আমার দাদা চান টিভি দেখতে। কিন্তু সেই সময় টিভি অন্যদের দখলে থাকে। কাজেই এটা অসম্ভব কিছু নয় যে, রিমোট তিনিই লুকিয়ে রেখেছেন। আমার সন্দেহ সত্যি হলো। দুপুর তিনটায় দাদাকে দেখলাম টিভি খুলে খেলা দেখছেন। জিজ্ঞেসা করলাম, দাদা রিমোট কোথায় পেলে? তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, সোফার নিচে ছিল। আমার অবাক হয়ে বললাম, কোন সোফা? আমি তো সব সোফার কুশন উলটে দেখেছি। দাদা পির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন, যে সোফায় বসে ছিলাম, ওটা তো উল্টে দেখিস নাই, গাধা কোথাকার। আমি রিমোটের ওপর বসেছিলাম। অবশ্য ইচ্ছাকৃত নয়, মধের ভুলে। বয়স হয়ে গেছে তো...
কথাটা বলার সময় তার মুখে মিটমিটি হাসির রেখা দেখা গেল। এ থেকে পুরো কাহিনি অনুমান করা যায়। আপনাদের কি মনে হচ্ছে? উনারতো অনেক বুদ্ধি; উনি পাগল হলেন কী করে? এখানেই গল্পের আসল চমক! ওপর থেকে দেখলে উনাকে জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান মনে হয় বটে। মূলত উনি বোকা এবং পাগল। যেমন, এখন উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে টিভিতে খেলা দেখছেন। যে চ্যানেলে আসলে খেলাই হচ্ছে না। পুরনো ম্যাচ দেখাচ্ছে। আসল খেলা লাইভ দেখাচ্ছে অন্য একটি চ্যানেলে। এই সামান্য ব্যাপারটা উনি ধরতে পারছেন না। কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে হুল্লোড়ের শব্দ ভেসে এল। পাড়ার সব কয়টি বাসায় এখন ক্রিকেট চলছে। হইচইটা সেখান থেকেই। খুব সম্ভবত বাংলাদেশ উইকেট পেয়েছে কিংবা চার-ছক্কা মেরেছে। অবশ্য আমাদের টিভিতে যে খেলাটি চলছে, সেটি একেবারেই নিরুত্তাপ।
খানিকবাদে আবারও হইচই ভেসে এল। আশপাশের বিল্ডিং থেকে এবার পরিষ্কার শোনা গেল- "ছক্কা ছক্কা"। তার মানে বাংলাদেশ বোধ হয় ছয় টয় পিটিযেছে। আমাদের টিভিতে তাকালাম। সেখানে ছয় পিটানোর কোনঙ লক্ষণ দূরে থাক, বাংলাদেশ গভীর মনোযোত দিয়ে ফিল্ডিং করছে। এই ব্যাপক হট্টোগোলেট দাদার অবশ্য ভাবান্তর হচ্ছে না। তিনি নিবিষ্টচিত্তে পুরনো ঢেলা দেখে যাচ্ছেন। আমাদের বাসাটা মজার তাই না? পুরনো খেলা কতক্ষণ দেখা যায় বলুন? একটু বাদেই ভীষণ ঘুম পেল। রুমে এসে সব বালিশে মাথা রেখেছি, দাদাজান দরজায় নক করলেন। দরজা খোলার পর খুব বিব্রত গলায় বললেন, আমাদের টিভিতে বোধহয় কোনো সমস্যা হয়েছে রে। খেলা স্লো দেখাচ্ছে। বাইরে সবাই ছয়-ছয় করতাছে। কিন্তু টিভিতে বাংলাদেশ এখনও তো ব্যাটিং-ই শুরু করে নাই। এর মানে কী? পাশের বাসায় গিয়ে একটু খবর নিয়ে দেখবি না কি?
আমি দাদাকে বললাড, আমাদের টিভিতে কোনো সমস্যা নাই দাদা। বাইরে হইচইয়ে কান দিও না তো। মন দিয়ে খেলা দেখে যাও। ক্রিকেট খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে হয়।
দাদা খানিটা বিভ্রান্তি নিয়ে আবার টিভির সামনে গিয়ে বসলেন। দাদাকে দেখে কে বলবে - আমাদের বাসায় ভয়াবহ একবা সমস্যা চলছে। সমস্যার কথাটা খুলেই বলি, কাউকে বলবেন না, কেমন? আমার বাবা প্রেমে পড়েছেন। খুবই কেলেঙ্কারি অবস্থা।
বাসার বড়রা এটা নিয়ে সারাক্ষণই আলোচনা করে। আমাকে দেখলেই সেই আলঅচনা চট করে থেমে যায়। কিন্তু পাগলের বাসা হবার একটা উপকারিতা আছে। কেউ আস্তে কথা বলতে পারে না। কাজেই সব কথা এমনিতেই কানে ভেসে আসে। অবশ্য কথাগুলো কানে না এলেও জানতে পারতাম। আমার মা একদমই পেটে কথা রাখতে পারে না। একদিন তিনি আমার ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, তোর সাথে কথা আছে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, বলো মা। তুই তো এখন বড় হইছিস, তোকে সব বলা যায়। আমি আবারও হাই তুললাম, আমি মোটেও বড় হইনি মা, হবে ক্লাস টেনে পড়ি। মা আমার কথা কানে তুললেন না। বললেন, ক্লাস টেনে পড়ার সময় অনেক মেয়ে দুই বাচ্চার মা হয়ে যায়।
তারপর মা একটা ছবি বঘর করলেন। বললেন, তোর বাপেয কান্ড দেখছিস? এই ডাইনি বুড়িটার প্রেমে পড়ছে।
আমি ছবিটা দেখলাম। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সুন্দরী। আমি বললাম, কোথায় ডাইনি। খুব কিউট চেহারা তো। নাকটা কত লম্বা দেখেছ?
আমার মা অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার গালে ঠাস কলে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। এরপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। সেই থাপ্পড় খেয়ে নাকি মায়ের কষ্ট দেখে,
ঠিক ধরতে পারছি না।
Comments
Post a Comment