কাবিননামার কসম।

গতরাত ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাত্রি।
রাত দুইটার মতো বাজে। আমি ল্যাপটপে গভীর মনোনিবেশ সহকারে, দারুন দরকারি একটি কাজ করছি। আচমকা মাথার উপর পত পত শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। উপরে তাকিয়ে আমার রক্ত হিম হয়ে গেলো। দেখি বিশালাকায় একটি কদাকার পাখি, খুব সম্ভবত ইগলই হবে, ডানা মেলে উড়ছে। এই সময় যেকোনো সাহসী বাঙালি পুরুষ যা করে, আমিও তাই করলাম। ও মাগো বলে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর এক দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে ঘুমন্ত স্ত্রীর কোলে ঝাপিয়ে পড়লাম।
বৌ'নী চমকে উঠলো। কী হয়েছে তাহীম?
আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, বৌ'নী ড্রয়িংরুমে একটা ভয়ংকর খেচর উড়ছে। ঈগল বা বাজপাখি কিছু একটা হবে। বাঁচাও বৌ'নী, বাঁচাও। পুলিশে ফোন দাও। দোয়া দুরুদ পড়ো।
আমার স্ত্রী কিঞ্চিৎ মার্কিন বিরোধী। কাজেই খেকিয়ে বলল, এটা কি তোমার আমেরিকা পাইছো? খুলনা শহরে তুমি ইগল কোথায় পাবে?
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বললুম, বৌ'নী আমাদের কাবিননামার কসম। ওটা ঈগল কিংবা উঠপাখি কিছু একটা হবে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিশ্বাস করো। খবরদার ওই ঘরে যেও না।
শতকরা একশত ভাগ বাঙালি স্ত্রী যেমনটা হয়, আমার স্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নন। তারা ভূত বিশ্বাস করে, কিন্তু স্বামীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। কাজেই বৌ'নী খটাস করে দরজা খুলে গ্যাট গ্যাট করে ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটা দিলো। আমি কাঁথার নিচ থেকে ব্যাকুল কন্ঠে বললাম, বৌ'নী যেও না। তোমার কিছু হলে, কালকে সকালের নাস্তা কে বানাবে?
বৌ'নী ড্রয়িংরুমে আসলো। তারপর হি হি করে হেসে দিলো। বলল, ওমা, ওটা তো চামচিকা।
কথাটা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসলো। আমার যেকোনো অর্জনকে খাটো করে দেখা বিদুর অভ্যাস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইজের বাঁদুরকে সে চামচিকা বলে উড়িয়ে দিলো। কেননা ওটা আমি দেখেছি। এই স্ত্রী লইয়া আমি কি করিবো?
বেডরুমে ঢুকে বৌ'নী দরজা লক করে দিলো। বলল, রাত অনেক হয়েছে। আর ল্যাপটপে বসে থাকার দরকার নেই। তুমি ঘুমাও। সকাল হলে ওটা এমনিতেই চলে যাবে। ভয় নেই, আমি দরজা লক করে দিয়েছি।
ঘুমানোর উপায় নেই। কেননা ড্রয়িংরুমে আমার ল্যাপটপে ফেসবুক খোলা। আমি কয়েকটা সুন্দুরী মানুষের সাথে বাংলাসাহিত্যে প্রেমের বিবর্তন নিয়ে চ্যাট করছিলাম। সকালে বৌ'নী ওটা দেখলে সর্বনাশ। মেরে আমাকেই চামচিকা বানিয়ে দেবে। কাজেই এই মুহুর্তে প্রথম করণীয় কাজ হচ্ছে ল্যাপটপ অফ করা। আমি বেডরুম থেকেই দিব্যি শুনতে পাচ্ছি আচমকা চ্যাট বন্ধ করে উঠে যাওয়ায়, সমানতালে টিং টিং করে ইনবক্স আসছে। মানসচোক্ষে দেখলাম, মেয়েরা লিখছে, হোয়াটস আপ বেইবি। আর ইউ দেয়ার?
এই মহাসংকট থেকে বাঁচার উপায় কি? ফেসবুক আছে ল্যাপটপে, ল্যাপটপ আছে ড্রয়িংরুমে আর ড্রয়িংরুমে আছে সেই ভয়াল বাজপাখি। যে বাজপাখি বাবা মায়ের সঠিক যত্নের অভাবে চামচিকা হয়ে জন্মেছে।
একটা সিগারেট ধরানো দরকার। তখনই আমার মনে পড়লো, সিগারেট প্যাকেটও ল্যাপটপের পাশেই রেখে এসেছি।
আমি ঘন্টাখানেক ভেবে একটা উপায় বের করলাম। আলমারি খুলে রেইনকোট বের করলাম। কালো রংয়ের সেই রেইনকোটটা গায়ে চাপালাম। ম্যাচিং করে কালো কালো ট্রাউজার পড়লাম। পায়ে কালো মোজা। আমেরিকায় যাবার সময় কালো গ্ল্যাভস কিনেছিলাম। ওটাও হাতে দিলাম। চোখে কালো সানগ্লাস দিলাম। যাক, পুরো শরীর এখন সুরক্ষিত।
বৌ'নী আমাকে দেখে হি হি করে হেসে ফেলল। বলল, তোমাকে এখন সত্যিই চামচিকার মতো দেখাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এই ধরাচূড়ো খোলো। ছেলেমেয়েদের ঘুম ভেঙ্গে গেলে তোমাকে দেখে ভয় পাবে।
স্ত্রীর কথায় সবসময় কানে দিতে হয়না। যুদ্ধে যাবার সময় স্বজনরা তো বাঁধা দেবেই।
আমি বাথরুম থেকে একটা বালতি আর লাঠি নিয়ে বের হলাম। লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে চামচিকা কাম বাদুর কাম ইগলপাখিকে ধরাশায়ী করবো। মাটিতে পড়ার পর বালতি দিয়ে চেপে ধরবো। এটাই হচ্ছে আমার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা।
কী আশ্চর্য ঘটনা। লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে হলো না। আমাকে দেখেই চামচিকাটা ধপাস করে উড়ন্ত অবস্থা থেকে মাটিতে পড়ে গেলো। বৌ'নী ফিসফিস করে আমাকে বলল, তোমাকে দেখে চামচিকা অজ্ঞান হয়ে গেছে।
এবার আমি বালতি চেপে ধরলেই কাজ শেষ। কিন্তু এইসময় একটা ছোট্ট সমস্যা হয়ে গেলো। আমার চোখে ছিল সানগ্লাস। কাজেই আমি স্পষ্ট করে দেখতে পারছিলাম না। আর ভয়ের চোটে আমার হাত কাঁপছিলো। কাজেই টিপ করে বালতি ফেলার আগে সেই কুচক্রী পাখিটা আবার উড়াল মারলো। আমি বিকট স্বরে ডেকে উঠলাম, মাগো ....
আমার মা প্রেশারের রোগী। উচ্চ মাত্রার ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিনি ঘুমান। ডিনামাইট ফাটলেও তার ঘুম ভাঙে না। এটা কিন্তু রসিকতা নয়, পরীক্ষিত সত্য। যে ডাক্তার এই ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন, এটা খুব কড়া ঘুমের ওষুধ। ডিনামাইটের শব্দেও ঘুম ভাংবে না। ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করার বান্দা আমি না। আম্মুকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আমি নেট থেকে ডিনামাইটের শব্দ ডাউনলোড করে বাজিয়ে দেখেছি, ঘটনা সত্য। আম্মুর ঘুম ভাঙে না।
তবু সন্তানের আকুল ডাক জননী শুনবেন না, তা কি হয়। আমার মাগো ডাক শুনে তিনি তার রুম থেকে দৌড়ে আসলেন। দেখলেন আপাদমস্ত কালো রেইনকোট জড়ানো একটা মানুষ। পাশে তার পুত্রবধু। তার মাথা ঘুরে গেলো। তিনি কাত হয়ে পড়েই যাচ্ছিলেন। বৌ'নীর ধরায় রক্ষা। তাকে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়া হলো। আমাকে দেখে তার প্রেশার হুট করে বেড়ে গেছে।
এত কান্ডের পর চামচিকার আর সাধ্য আছে এই বাসায় থাকার?
ওই হারামজাদা চামচিকা পুরো সংসার তছনছ করে পালিয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !