কোলকাতা !

পর্ব ১
একবার দারুন বিপদে পড়েছিলাম। বোম্বে থেকে ট্রেনে উঠেছি। কলকাতা যাবো। ট্রেনের নাম হাওড়া এক্সপ্রেস। বেশ সস্তার ট্রেন। মোটামুটি দিন দুয়েক ট্রেনেই থাকতে হবে।
ট্রেনে ওঠার পর আমার পাশের সিটে বসেছেন, কলকাতার এক দাদা। মোটামুটি মস্তান টাইপের মানুষ। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর, তিনি বললেন, এই তোমার চপ্পলখানা দাও দিকিন। একটু টাট্টিখানায় যাবো।
এই বলে সেই ভদ্রলোক আমার স্যান্ডেল নিলেন। বেশ ভালো স্যান্ডেল । বাটা কোম্পানির। ওমা। সেই লোক আর স্যান্ডেল দেয় না। স্যান্ডেল পরে হাঁটে, অন্য কামরায় যায়। ঘোরাঘুরি শেষে সেই স্যান্ডেল সিটের তলায় নিয়ে শুয়ে থাকেন। বিদেশ বিভুই জায়গা। সাহস করে কিছু বলতে পারি না। একবার ক্ষীণ গলায় বললাম, ও দাদা, স্যান্ডেলটা দেবেন। বাথরুমে যাবো।
সে লোক ঝাড়ি মেরে বলল, আরে বোসো। তোমার চপ্পল তো আমি খেয়ে ফেলছি না। দোবো। এত অস্থির হচ্ছো কেন।
ঝাড়ি খেয়ে আমি তবদা মেরে বসে আছি। পুরো কামরার লোকজন দেখছে। কেউ কিছু বলছে না। এমন সময় একটা ভীষণ কালো মতো লোক খুব ঠান্ডা গলায় হিন্দিতে কলকাতার দাদাকে একটি বাক্য বলল। হুবহু হিন্দি বাক্যটা বলতে পারবো না, শুধু মনে আছে, সে বলল, ওহে বান্দির পুত, এই বাবুর স্যান্ডেল ওপাস করো।
তার এই ঝাড়ি শুনে কলকাতার দাদা কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। হাতে করে স্যান্ডেল এনে আমার পায়ের কাছে রাখলেন।
আমি সেই কালো মতো লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কৃতজ্ঞতার হাসি। হাসির তো হিন্দি বাংলার সমস্যা নেই। সেই লোকটি বলল, তুমি বাংলাদেশ থেকে আসছো? ইধার আও। মেরা পাশ মে বসো।
আমি লোকটির পাশে গিয়ে বসলাম। আর এভাবেই আমার সাথে কামাল ভাইয়ের পরিচয় হয়ে গেলো।
কামাল ভাই বললেন, ইন্ডিয়া থোড়া ট্রিকি প্লেস। তোমার চোখ থেকে এরা সুর্মা চুরি করে ফেলবে, তুমি টেরও পাবা না। পায়ের চপ্পল তো কোন ছাড়।
একটু পর ডাইনিং কার থেকে খাবারের অর্ডার নিতে আসলো। আমি ভেজিটেবল কারির অর্ডার দিলাম। যথা সময়ে খাবার এলো। প্যাকেট খুলে চামচ দিয়ে একটু নাড়া দিয়েছি , একটা ছোট্ট তেলাপোকা পেলাম খাবারের মধ্যে।
গা রি রি করে উঠলো।
কামাল ভাই রেলের এটেনডেন্টকে ডেকে আনলেন। সে বেচারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর হিন্দি গালি যোগে তাকে অ্যাপায়ন করা হলো। লোকটি ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। কামাল ভাই একটু শান্ত হলেন। মৃদু স্বরে বললেন, এই বেচারা বিদেশী মানুষ। ভেজিটেবল অর্ডার করেছে। তুমিই বলি, তেলাপোকা ভেজ না নন ভেজ? তার খাবারের মধ্যে ননভেজ কেন দিলা? বোল না শালে, বোল, বোল? ননভেজা কিউ দিয়া?
আমি লোকটাকে পছন্দ করতে শুরু করলাম।
আমার শার্টের পকেটে সিগারেট দেখে বলল, তুমি কি স্মোক করো?
আমি বললুম, হ্যাঁ। তবে ট্রেনে তো সিগারেট খাওয়া যায় না। রাত আরেকটু বাড়লে দরজায় বসে খাওয়ার চেষ্টা করবো।
কথাটা শুনে ঠা ঠা করে হেসে দিলেন কামাল ভাই। তারপর যেটা বললেন, সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বললেন, তুমি কামাল ভাইয়ের গেস্ট। সিটে বসেই সিগারেট খাও। কোনো শালে তোমাকে ডিস্টার্ব করতে আসবে না।
সারা রাত কামাল ভাইয়ের সাথে গল্প হলো। উনার পেশা কি জানতে চাইলে উনি বললেন, উনি একজন ভাই।
ভাই আবার কারো পেশা হয় নাকি?
আজ অনেক রাত হয়ে গেছো। বাকী গল্প পরে বলি। । কেমন?


পর্ব ২
পরদিন সকালে ট্রেনটা একটা স্টেশনে থামলো। সারা রাত বসে থেকে হাত পায়ে খিল ধরে গেছে। স্টেশনে ট্রেনটা থামা মাত্র, পাশের যাত্রীকে শুধালাম, এখানে ট্রেনটা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।
সহযাত্রী জানালেন, কমসে কম পনেরো মিনিট।
কথাটা শুনে আমি লাফ দিয়ে স্টেশনে নামলাম। একটু পরে আবিষ্কার করলাম পাশে কামাল ভাই। উনি সারা রাত আমার সাথে গল্প গুজব করেছেন। একটু আগেই দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন। এখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাই তুলছেন।
আশপাশের কামরা থেকে কয়েকজন নেমে আসলো। তারা কামাল ভাইকে ঘিরে দাঁড়ালো। আমি দারুন বিস্ময়ে সাথে দেখলাম, সবাই খুবই তমিজের সাথে কামাল ভাইকে সালাম দিচ্ছেন। এমনকি দুর দুরান্তের কামরা থেকে একজন দুইজন করে নেমে এসে কামাল ভাইকে সালাম দিচ্ছেন এবং আপাদমস্তক বিনয় নিয়ে উনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন।
কেন জানি আমার মুখ শুকিয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে বললাম, কামাল ভাই, এরা কারা?
শিশুর মতো সরল মুখে কামাল ভাই বললেন, এরা? এরা হামারা দোস্ত হায়। একসাথে কলকাতায় পিকনিক করতে যাচ্ছি। টিকেটের নম্বর উল্টাপাল্টা হওয়ায় একেক জনের একেক দিকে সিট পড়েছে।
কামাল ভাইয়ের কথা শুনে আমার গলা আরও শুকিয়ে আসলো। পাশ দিয়ে এক ভাড়ওয়ালা চা নিয়ে যাচ্ছিলো। আমি এক খুপড়ি চা নিলাম। দাম দিতে গিয়ে ব্যাপক ধাক্কা খেলাম। চাওয়ালা হাত জোড় করে বলল, মাফি মাংতা। আপকা কামাল কা দোস্ত হ্যায়। পয়সা কিউ দিচ্ছেন?
এবার আমার পুরো মেরুদন্ড ঘামতে শুরু করেছে। কাহিনী কি?
কামাল ভাই অবশ্য দারুন নির্বিকার। বললেন, চা পিতে, চা পিতে। ছাগলের দুধের চা। খুবই ভালো।
সেই চা আমার গলা দিয়ে নামলো না।
আমি ট্রেনে গিয়ে বসলাম। ডাইনিং কার থেকে সকালের নাস্তা দিচ্ছে। উর্দি পরা বেয়াড়ারা নাস্তা পরিবেশন করছে। আমি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট কিনলাম। দাম দিতে গিয়ে বললাম, কালকে রাতের খাবারের দাম নাও নি কেন? আজকের নাস্তাসহ বিল কত হয়েছে?
উর্দিপরা বেয়াড়া জিহবা বের করে বলল, ছি ছি। বেয়াদবি করে থাকলে, মাফি মাংতা। আপনি কামাল ভাই কা গেস্ট হায়। আপনার কাছ থেকে দাম নেবো? আমার গর্দানে কয়টা মাথা?
বেচারা নিজের কানে হাত দিয়ে আমাকে পুরো একটা কুর্নিশ করে কেটে পড়লো। আর সেই সময় প্রবল ভয়ে আমার পেট কামড়ানো শুরু হলো। খোদা, একি বিপদে পড়লাম। এই কামাল ভাই, শালার পুত কে?
শালা, কি বিপদে পড়লাম? এই লোকের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি?

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !