বনানী রেলস্টেশন !
তুমি বসে আছ একটা ঘুম ঘুম রেল স্টেশনে। শীতের মাঝদুপুরেও সকালের আলস্য। মিষ্টি রোদ তেরছা ভাবে পড়েছে তোমার গালে। হালকা কনকনে একটা বাতাস দিচ্ছে বলে চাদরটা একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিলে তুমি। তোমার পাশে, পায়ের কাছাকাছি অবহেলায় পড়ে আছে তোমার ট্রাভলিং ব্যাগ। একবার ওটার দিকে কটমটে চোখে তাকালে। কবি-সাহিত্যিকেরা যাকে লেখেন অগ্নিদৃষ্টি। যেন তোমার সব রাগ-ক্ষোভ ওটার ওপরেই। আর ব্যাগটাও কেমন কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে পড়ে আছে দ্যাখো! যেন মাথা নত করে রাখা অপরাধী। যেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া কয়েদি। যেন প্রাণভিক্ষা করছে তোমার পায়ে পড়ে।
স্টেশনে যাত্রীর চেয়ে খুচরো হকারের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাদেরও তেমন হাঁকডাক নেই। বস্তুত এ রকম স্টেশন এ তল্লাটে, জনারণ্যের এই দেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু আমাদের গল্পের প্রয়োজনে তোমার চারপাশে নিঃসঙ্গ একটা জগৎ তৈরি করা দরকার। দরকার বলে পুরো স্টেশনে যাত্রী হিসেবে শুধু তোমাকেই আঁকা হয়েছে। তুমি বুদ্ধিমতী। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এও বুঝে গেছ, তোমাকে আঁকা হয়েছে কোনো কারণে প্রচণ্ড রেগে থাকা একজন তরুণী হিসেবে। যে তরুণী ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে সোজা হাজির রেল স্টেশনে। কিন্তু গন্তব্য তার গন্তব্যহীন। সত্যি বলতে কি, তোমার পার্সের ভেতর এই মাত্র উঁকি দিয়ে দেখলাম, তুমি এখনো ট্রেনের টিকিটই কাটনি।
সে যাকগে। আমাদের হাতেও যথেষ্ট সময় আছে। আর তাড়াহুড়ো করে কিছু লিখতেও নেই। আগে ভালো করে অবজারভেশন করা চাই। তার পর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে তুলে আনতে হবে শব্দ-দৃশ্য-কল্প। আমি তাই গভীর মনোযোগী। এতটাই মনোযোগী, আৎচমকে আবিষ্কার করলাম, তোমার বাঁ চোখের নিচের পাতার খানিক দূরে একটা তিল।
আশ্চর্য, দশ বছরের প্রেম এবং দুই বছরের প্রেমহীন দাম্পত্য জীবনের এই এক যুগে তোমাকে দেখেছি। এক যুগ মানে ৪৩৮৩ দিন, এক যুগ মানে ১ লাখ ৫১৯২ ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাবটা নিশ্চিত লাখ আর কোটির ঘরে। এর মধ্যে দু-তিনটে অধিবর্ষও গিয়ে থাকতে পারে। এতটা সময়, এত কাছাকাছি, নিশ্বাস দূরত্বে থেকেও তোমার ওই তিল আমি আগে কখনোই দেখিনি! আচ্ছা তুমি কি জানো, আমার কপালের ডান পাশে হালকা, সন্ধ্যার আলোতে মিলিয়ে যাওয়ার মতো একটা কাটা দাগ আছে?
উত্তরটা তোমার কাছ থেকে তখনই পাব, যদি আমাদের আবার কখনো দেখা হয়। রাগের মাথায় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তুমি যা বলে গেছ, তাতে অবশ্য আরেকবার আমাদের দেখা হওয়ার সামান্য সম্ভাবনাটুকুও দেখছি না। তোমার তিল আগে খেয়াল না করে থাকতে পারি, কিন্তু তোমার প্রচণ্ড অভিমান, প্রচণ্ড রাগ, প্রচণ্ড জেদ আমার ভালো করেই জানা।
হায়, সেই 'প্রচণ্ডে'র তালিকায় এক সময় আমার প্রতি তোমার নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসাও ছিল। কিন্তু কি জানো, সংসার জীবনটাই বড় শর্ত এবং স্বার্থের বেড়াজালে বন্দী।
না, লেখাটা বড় গম্ভীর দিকে মোড় নিচ্ছে। উঁচু দর্শন দিয়ে ভারাক্রান্ত করা মানেই এই গল্পের স্থান সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলের পাশে রাখা বাতিল লেখার ঝুড়ি। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এই গল্পে একটা সংলাপও আমরা দেখতে পেলাম না। এ কেমন বোবা-বোবা গল্প হয়ে যাচ্ছে ভাই!
একটু হেঁটে একটা চায়ের দোকানে গেলে তুমি। কিংবা বলা যায়, তোমাকে আমিই নিয়ে গেলাম। কারণ আমার গল্পে এখন সংলাপের প্রয়োজন পড়ে গেছে। চা দোকানি তার কোনো কালেই পেস্ট-ব্রাশের স্পর্শ না-পাওয়া দাঁত বের করে অভ্যর্থনা জানাল তোমাকে, 'আফা চা খাইবেন?'
এমন সহাস্য আন্তরিক অভ্যর্থনা যে ওই দোকানি সবাইকেই দেয়, সেটা ভেবো না। তোমাকে দিচ্ছে। তুমি সুন্দরী, তোমার বয়স পঁচিশ ছুঁই ছুঁই। তোমাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে সবার। তা সে ছয় অঙ্কের বেতন পাওয়া করপোরেট অফিসের এমবিএধারী হোক; হাঁপানি রোগীর মতো ঝিমুতে থাকা সরকারি কেরানি, উদ্ভ্রান্ত যশঃপ্রার্থী কবি, ক্রিকেটার সাকিব কিংবা ঢালিউডি হিরো শাকিব, ছা-পোষা রোজগেরে জীবনযাপন করা রোমান্সবিবর্জিত মাঝবয়সী, মিছিলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া টগবগে তরুণ... আমার মতো দুই পয়সার লেখক কিংবা আমার চেয়ে সামাজিক অবস্থানে এক ধাপ উঁচুতে অবস্থানকারী ওই চা দোকানি; বিশ্বাস করো, তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে সবার।
তুমিও সেটা জানো। সত্যি বলতে কি তুমি সেটা উপভোগই করো। সব সুন্দরীই করে। কপট একটা বিরক্তিও অবশ্য তারা প্রকাশ করে অনেক সময়। সেই কপটতাও যেন তাদের সৌন্দর্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তবে তুমি এদের মধ্যে থেকেও আলাদা। চায়ের দোকানে একজন তরুণী চা ছাড়া আর কীসের জন্যই বা আসতে পারে! অন্য সময় হলে কষে একটা জবাব দিতে ওই দোকানিকে। বলতে, 'না ভাই, চা খেতে নয়, আমি আসলাম আপনার সাথে গল্প করতে। আপনি ভালো আছেন!' তোমার সেই ঝাঁঝ মেশানো কথার মর্মার্থ বোঝার মতো বিচারবুদ্ধি দোকানির থাকত। নিমেষেই তামাটে দাঁতের পাটি বন্ধ হয়ে যেত তার।
কিন্তু আজ তুমি নিয়ম ভাঙার পণ করেছ। আজ তুমি যেন তুমি নও। দোকানিকে তাই তুমিও উপহার দিলে হ্যাঁ-বোধক একটা হাসি। চায়ের কাপে অদ্ভুত ছন্দ তুলে অভ্যস্ত হাতে দ্রুতই ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা সে তৈরি করে দিল তোমার জন্য। ক্যানভাসে শিল্পীর শেষ তুলির আঁচড়ের মতো উপরিভাগে জমা পড়া ফেনাগুলো চামচ দিয়ে উপড়ে নিল। জীবনের সমুদ্র সফেনের মতো ওটাও বড্ড অর্থহীন কিনা। আচ্ছা ওই চা-দোকানি, যার নাম এই মুহূর্তে আমি নিরানন্দ দাস দিলাম, সে কি জীবনানন্দ পড়ে?
চাদরের আড়াল থেকে সন্তর্পনে বেরিয়ে আসা সুন্দর একটা হাত ধন্য করে দিল মলিন চায়ের কাপটিকে, স্পর্শ দিয়ে। শিল্পীর তুলিতে আঁকা তোমার ওই ঠোঁট জোড়া নিঃশব্দ একটা ফুঁ দিয়ে যেন খানিকটা ঠান্ডা করে নিল। এর পর দামি লিপ গ্লস বাঁচিয়ে কায়দা করে আলতো চুমুক।
ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে, চায়ের কাপে নাকের সর্দির মতো ল্যাপ্টে আছে কনডেন্স মিল্ক। আরও ভালো করে খেয়াল করলে, চায়ের কাপের একটা কোনা যে ভাঙা, সেটাও নজরে পড়ত তোমার। কিংবা একটু ভেবে দেখলে তুমি বুঝতে, তোমার মহামূল্যবান ঠোঁটের স্পর্শে ধন্য হচ্ছে যে কাপ, সেখানেই মেথর-মুচি-রিকশাওয়ালা এবং আমাদের মতো বাউন্ডুলে লেখকদেরও স্পর্শ পড়েছে বহুবার।
অন্য সময় হলো ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠত তোমার। ছুড়ে ফেলতে চায়ের কাপ। এতটাই শুচিবায়ু তোমার। এতটাই, কামতাড়িত হলে তুমি হয়তো আমার নিকোটিনে পোড়া ঠোঁটে চুমু এঁকে দিতে পারো, কিন্তু অন্য সময় আমার চুমুক দেওয়া গ্লাসে পানি খেতেও তোমার ভীষণ আপত্তি।
একটাই শূচিবায়ুগ্রস্ত তুমি, হলুদ রঙের বিছানায় শুলে তোমার অস্বস্তি হয় বলে, মনে আছে, বিয়ের প্রথম রাতেই 'নববর' আমাকে ছুটতে হয়েছিল বিছানার নতুন চাদর কিনতে।
আমাকেই যেতে হয়েছিল। কারণ, বিয়ের, আমাদের দুই থেকে এক কিংবা এক থেকে দুজন হয়ে যাওয়ার দিনে আমরা আরও নিসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে আকস্মিকভাবে সবার অমতে বিয়ে করাটা আমার পরিবার সহজভাবে নিতে পারেনি। তোমার পরিবারের নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
যুক্তি দুই পক্ষেরই আছে। ঘরে সোমত্ত বোন রেখে, একার সিদ্ধান্তে বিয়ে করেছি বলে মা আমার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। বাবা অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ তাঁর হিসাব ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। তিন পুত্রকে বিয়ে দেওয়া বাবদে তিনি তিন-দুগুণে ছয় লাখ টাকা পণ বাবদে আদায় করে তিনি নিজে কন্যাদায় থেকে মুক্তি পাওয়ার বস্তুত অলীক এক পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। যদিও দুই-দুগুণে চার লাখ টাকা আদায়ের সম্ভাবনা যে এখনো আছে, সেই ইতিবাচক দিকটা আমি তাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিজের ঘরে খিল এঁটে ঢোকার পর তিনি আর বেরই হননি।
তোমার বাড়িতে অবশ্য সেদিন পা রাখার বোকামি কিংবা সাহসী উদ্যোগ আমি নিতে পারিনি। তুমি তো জানোই, যতই আমরা ঠাট্টা করি, শেষ পর্যন্ত আমাদের সিংহভাগেরই জীবনের স্টোরি-লাইন ষাট-সত্তর দশকের সেপিয়া টোনের বাংলা সিনেমার মতোই। ধনবান নায়িকার বিপরীতে আমিও তাই নিজেকে আবিষ্কার করি চালচুলোহীন দরিদ্র এক নায়ক হিসেবে। এবং আমার জীবনের স্ক্রিপ্ট রচয়িতা বোধ হয় বড্ড নিওরিয়্যালিজমে বিশ্বাসী। সেও তো একজন লেখক। আমার মতো নৈরাশ্যের অতলে, হতাশার ডুবোচরে তলিয়ে যেতে থাকা দুই পয়সার লেখক।
কিন্তু তুমি জানো, ভালো করেই জানো, আমার লেখক সত্তা নিয়ে কেউ সামান্য আঘাতও করলে আহত বাঘের মতো ফুঁসে উঠি আমি। সবই অক্ষম আক্রোশ হয়তো। হয়তো বাষ্পীয় রাগ এক সময় কান্নার বৃষ্টি হয়েও ঝরে। কিন্তু আমাকে, আমার লেখক সত্তার অহংবোধে সামান্য আঁচড়টুকুও সহ্য হয় না।
আমার লেখক সত্তা নিয়ে এই প্রচণ্ড আত্মগৌরব, হয়তো অযাচিতও, তুমি সমীহ করতে। আমার মতো আক্ষরিক অর্থেই চালচুলোহীন লেখককে তার পরও তাই ভালো লেগেছিল তোমার। সুনীলকে যেমন ভালো লেগে গিয়েছিল বনেদি পরিবারের স্বাতীর। আচ্ছা, স্বাতী কি কোনো দিন সুনীলের আর্থিক দৈন্য নিয়ে খোঁচা দিতে গিয়ে তাঁর লেখক সত্তাকে আক্রমণ করেছিলেন কোনো দিন? না হলে সুনীল কেন নীরার কাছে আশ্রয় খুঁজতে চাইবেন! আজন্ম ভিখেরির মতো শূন্যতার কুঁজো দেখিয়ে নতজানু প্রার্থনা করবেন, 'নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র/ আমাকে দেবে না?'
আমার কোনো নীরা ছিল না। মাধুকরী এই আমার হাত পেতে দেওয়ার মতোও ছিল না কেউ। আমার ছিলে শুধু তুমি। তুমিহীনা আমি তাই আশ্রয়হীন ভবঘুরে। কিন্তু সেই তুমি আমার লেখক সত্তাকে আক্রমণ করে বসলে। অকস্মাৎ! যেমন মেঘের বুক চিরে মাটিকে কাঁপায় বজ্র!
তোমার তূণে অস্ত্রের তো শেষ ছিল না। চাইলে তুমি বিশ্বের ব্যর্থতম মানুষদের একজন আমার বাবাকে নিয়ে অপমান করতে পারতে আমাকে। আমার এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত চাচা, যিনি উপায় খুঁজে না পেয়ে ভিক্ষুকই হয়ে গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত, একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে গলির মুখে আবছা অন্ধকারে দুটো পয়সার জন্য আমার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া জীর্ণ শরীরের হাতটি, আর কারও নয়, আমারই আপন চাচার দেখে হঠাৎ টলে গিয়ে আমার পৃথিবী। রোমান্টিকতা উবে গিয়েছিল কর্পূরের মতো।
আমাকে খোঁচা দেওয়ার জন্য তোমার হাতে তো সেই মারণাস্ত্রও ছিল। কিন্তু না, তুমি যে আমাকে আমার সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাতেই আঘাত করলে। পুরো পৃথিবীকে এক পাল্লায় রেখেও আমি টিকে ছিলাম, এ পাশের পাল্লায় শুধু তুমি ছিলে বলে। পৃথিবীর 'দুই পয়সার লেখক' গঞ্জনাকে আমি গায়ে মাখিনি শুধু তুমি আমার লেখক সত্তাকে শ্রদ্ধা করতে বলে। সেই তুমিও কিনা, অতি সামান্য বিষয় নিয়ে শুরু ঝগড়ার একপর্যায়ে বলে বসলে, 'কী আছে তোমার, তুমি তো দুই পয়সার লেখক ছাড়া আর কিছুই নও, কীসের এত অহংকার!'
আমাদের ঝগড়ার শুরু এখান থেকেই। শীতের আলস্যমাখা মাঝদুপুরে, এই ঘুম ঘুম রেল স্টেশনে তোমার আগমনের হেতুও এটাই। তুমি আমার জীবন থেকে মুছে যেতে যাও, যেমন কলমের একটানে আমরা লেখকেরা সহসাই মুছে ফেলি অজস্র শব্দ, বাক্য; যেন ওই শব্দ-বাক্য-উপমা পঙ্গু হয়ে জন্মেছে, যেন তারা জারজ। লেখকেরা মায়ের মতো জন্মশীল, কিন্তু মায়াবতী নয়। এবং লেখকেরা কিছু ক্ষেত্রে হয়তো উন্নাসিকও।
খুব ভালো করে ভেবে দেখলে, তোমার কথায় যুক্তির ঝলমলে রোদ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আসলেই তো, কীসের এত অহংকার আমার? আমি তো প্রাচীন আস্তাকুঁড়, ক্ষয়ে যাওয়া জুতোর তলা, পথের ধুলোয় অনাদরে পড়ে থাকা অচল মুদ্রা।
কিন্তু আমি লেখক! আমি নির্মাণ করি আমার পৃথিবী। তিলে তিলে গড়ি প্রতিমা। তাতে প্রাণ দিই, ভাষা দিই। তাকে হাসাই, কাঁদাই।চাইলেই কোনো যুক্তিবোধ, ঘটনার পরম্পরা ছাড়াই এক লহমায় এখনই তোমার অহংকারী বাবাকে বানিয়ে দিতে পারি পথের ভিখিরি। চাইলেই আমার ভিখিরি পঙ্গু চাচা হয়ে যেতে পারেন স্যুট-টাইঅলা নিপাট ভদ্রলোক।
নিঃসীম আমার ক্ষমতা। তাকিয়ে দেখ, ভালো করে দেখ, তোমার চারপাশের জগৎটা শুধুমাত্র আমরা আঙুলের নির্দেশেই কেমন স্থির হয়ে আছে! স্থির হয়ে আছে চা-দোকানির সদ্য ব্যস্ত হাত, এক পা ফেলতে গিয়ে স্থির হয়ে আছে হকার, বোবা-স্থির হয়ে আছে বিদ্যুতের খুঁটিতে অলস ভঙ্গিতে রোদ পোহানো কাক, নিশ্চল হয়ে আছে একটু আগেই এ-পাশ ও-পাশ দুলতে থাকা লাইনম্যানের সবুজ পতাকা। সবুজ সংকেত পেয়ে ধীর কিন্তু শতসহস্র অশ্বশক্তি নিয়ে দুলকি চালে স্টেশনে এসে পড়া ট্রেনটাও কেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে আছে আমারই নির্দেশে!
ওগুলো থাক পড়ে থাক ওখানেই, যেভাবে আছে। সময়টাকে স্থির করে দিয়ে আমি আসছি তোমার কাছে। অভিমানাহত তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব বলে। তোমার সামনে দাঁড়াব যুদ্ধফেরত বিজয়ী কিন্তু ক্লান্ত সৈনিকের বেশে। নতজানু হয়ে বলব, 'আমি পুরুষ, আমাকে ক্ষমা করো।'
কিংবা ধরো, আমার সামনে খোলা আরও সহজ পথ। কি-বোর্ডের ব্যাক স্পেস চেপে ধরে তো আমি অনায়াসে মুছে ফেলতে পারি সময়, ঘটনা। এত হাঙ্গামার তাই কী দরকার? অনায়াসেই আমি তো ফিরে যেতে পারি আমাদের ঝগড়ার দিনটার শুরুতে।
আর তাই, বারান্দায় আলতো রোদে খুট খুট করে ল্যাপটপে লিখে চলা আমার পাশে এসে এইমাত্র দাঁড়ালে তুমি। স্নানের জল এখনো চুঁইয়ে পড়ছে তোমার চুল থেকে। তোমার হাতে চায়ের কাপ, চোখেমুখে একরাশ চিরচেনা বিরক্তি, 'কী, কখন বললাম বাজারে যাও। সারা দিন ঘাড় গুঁজে এই সব ছাইপাঁশ লিখলে হবে!'
মনোযোগের ঘুম থেকে উঠে, তোমার দিকে তাকাতেই, আৎচমকে আবিষ্কার করলাম, তোমার বাঁ চোখের নিচের পাতার খানিক দূরে একটা তিল...!
Comments
Post a Comment