আমি জীবনে একবারই গরুর হাটে গিয়েছিলাম।
তখন স্কুল থেকে সবে পাশ করেছি। কাকি আম্মা ডেকে পাঠালেন। কাকি আম্মার ডাক অগ্রাহ্য করার সাহস আমাদের কারোরই ছিল না।
ড্রয়িংরুমে পারিবারিক মিটিং। আমি, আহাদ, রাহাত, ডাক্তার কাকা, বাবা, মা, রাশেদ কাকা। পারিবারিক বৈঠকের সভানেত্রী যথারীতি কাকি আম্মা।
আমাদের গরু কিনতে যেতে হবে। অন্য কারো হাতে এবার দায়িত্ব দেয়া যাবে না। আমরা এতোগুলো পুরুষ মানুষ ঘরে বসে কি করি?
গরুর হাটে যাবার কথা শুনে আব্বু মাথা চুলকাতে লাগলেন। ডাক্তার কাকা গভীর মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজের মধ্যে ডুব দিলেন। আমার মনে হলো এক্ষুণি একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। কেবল আহাদ আর রাহাত দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলো। এই হাসির মানে আমি পরে বুঝেছি।
কাকা মৃদুস্বরে বললেন, কিন্তু এতো দূর থেকে গরু নিয়ে আসবো ক্যামনে?
কাকি আম্মা পরিষ্কার বলে দিলেন গরু বয়ে আনবার পদ্ধতি। গরুর পাশাপাশি রিকশা থাকবে। সেই রিকশায় থাকবেন আব্বু আর কাকা। গরুর দড়ি থাকবে তাদের হাতে। গরুর হাটবে, পাশাপাশি রিকশা চলবে।
পুরো বিষয়টা আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলুম। ঐরাবতের মতো গরু চলছে, পাশে রিকশায় বসা আব্বু আর কাকা। গরুর গলার দড়ি তাদের হাতে। পদ্ধতিটি আমার বেশ লাগলো।
কাকি আম্মা আমাদের হাতে টাকা দুই ভাগ করে দিয়ে দিলেন। যাতে টাকা চুরি না হয়, এজন্য দুইভাগে দেয়া হলো। পকেটমার হলে তো দুইজনের একসাথে হবে না।
আমাদের টিমে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দেয়ার জন্যে একজন পশু ডাক্তার রয়েছেন। তিনি গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। আর মানুষের ডাক্তারের জন্য কাকা তো আছেনই। আমার বাবা আবার এডভোকেট। সাথে রয়েছি আমরা তিন তরুণ, আমি, আহাদ আর রাহাত
আমাদের পারিবারিক হেলপিং হ্যান্ড রাশেদ কাকা তো আছেনই। মানুষের ডাক্তার, পশু ডাক্তার, আইনজ্ঞ সব মিলিয়ে পুরো দক্ষ জনশক্তিবহুল একটি টিম যাকে বলে।
আমরা গেলাম গাবতলির গরুর হাটে। আহাদ আর রাহাত হাটে ঢোকার আগেই হাওয়া হয়ে গেলো। গরুর হাটে ঢোকার মুখেই পর্বত সিনেমা হল। সেখানে এক টিকেটে দুই ছবি চলছে। বিদেশী নায়িকাদের বুক চিতানো ছবি ওদেরকে টেনে নিয়ে গেলো হলের ভেতরে।
হাটে ঢুকে আমি চমকে গেলাম। গাবতলির গরুর হাট। হাজারে হাজারে গরু সারিবদ্ধভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা। একবার মনে হলো যদি সব গরুর দড়ি ছুটে যায়, তাহলে দেশে একটা ''গরু ক্যু'' হয়ে যাওয়া ওয়ান টু'র ব্যাপার। ভাগ্যিস দড়ি দিয়ে ওদেরকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
হাটে ঢুকে প্রথম প্রহরে গরুর লাথি খেয়ে আব্বু কেতরে পড়ে গেলেন। ডাক্তার কাকা পা পরীক্ষা করে বললেন, কমপ্লিট ফ্রাকচার।
এর দশ মিনিটের মাথায় ডাক্তার কাকা ঘামতে শুরু করলেন। এই লক্ষণ আমার খুবই পরিচিত। আমি বললাম, কি কাকা? টাকা কি পকেটমার হয়ে গেছে?
কাকা মাথা নাড়লেন।
টাকা হারানোর ব্যাপারে আমার বাবা এবং কাকার প্রবাবতুল্য খ্যাতি রয়েছে। এই বিষয়ে তারা দুইজনেই জীবন্ত কিংবদন্তী। বাজারে যাওয়ার পথে প্রায়ই কাকা টাকা হারিয়ে ফেলেন এবং খালি বাজারের ব্যাগ হাতে আমাদের বাসায় চলেন আসেন। কাকি আম্মার বকুনির ভয়ে বাসায় ফেরেন না। ঘরে ঢুকেই বলেন, ও সাদের মা, আমার তো টাকা পিকপকেট হয়ে গেলো।
কাকাকে সাত্বনা দেয়ার জন্য লেবুর শরবত বানানো হয়। কাকা সবিস্তারে টাকা হারানোর গল্প করেন। তারপর দুপুরে আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করি। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বিকেলের দিকে কাকা বাড়ি ফেরেন।
অনেকদিন বাজারে গিয়ে বাবাও ফেরেন না। দুপুর গড়িয়ে গেলেই আমরা বুঝি বাবা টাকা হারিয়ে এখন কাকার ওখানে। হয়তো লেবু শরবত খাচ্ছেন ওই বাসায়। ভাতটাত খেয়ে বিকেলের দিকে বাসায় ফিরবেন।
এ সমস্তই চেনা গল্প।
কাজেই কাকার টাকা হারানোর সংবাদে আমি বিচলিত হলুম না।
পশু ডাক্তার অসাধ্য সাধন করলেন। অর্ধেক টাকা দিয়ে তিনি বিশ মিনিটের মাথায় একটা ''কিশোর গরু'' কিনে ফেললেন।
তখনই জানলাম, গরু কেনার পর ''হাসিল'' করতে হয়। গরুর মোট মূল্যের উপর একটা পার্সেন্টেজ জমা দিতে হয়। এই গরুর ইনকাম ট্যাক্সকেই হাসিল বলে।
হাসিলের জন্য আমরা লাইনে দাঁড়ালুম। ঠিক তৎক্ষণাৎ কারেন্ট চলে গেলো। অন্ধকারে টের পেলাম আমার পাশ দিয়ে পাই পাই করে কয়েকটি গরুর ছুটে বেরিয়ে গেলো। সাথে সাথেই কলরব, গরু ছুটছে, ধর; গরু ছুটছে, ধর। দড়ির ফাঁস দিয়ে লোকজন ছোটাছুটি অন্ধকারে শুরু করলো। এবং অতি বিস্ময়ের আবিষ্কার করলাম, কেউ একজন অন্ধকারে আমার গলায় দড়ি পড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
একবার ভাবলাম বলি, ভাই আমি মানুষ, গরু না।
তারপর মনে হলো, কি লাভ? গরু যদি মানুষের গলায় কথা বলে ওঠে, তাহলে কি কান্ড হয়ে যায়। তারচেয়ে কারেন্ট আসুক, আলোতে গরু মানুষ আলাদা করা যাবে। মনে মনে গাইলাম,
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।
হাসিল শেষে গরু নিয়ে আমরা হাট থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলাম। পিচ্চি গরু হলে কি হবে, ভীষণ তেজ। সকল বাঁধন ছেড়ে সে ছুটে পালাতে চায়। সতর্কতার জন্য আমরা পাঁচজনই দড়ি ধরে রেখেছি।
সেই সময় মনে হলো, বাকি চারজন তো দড়ি ধরে রেখেছেন। আমার কীসের ঠ্যাকা? আমি হাত আলগা করলাম।
খুব সম্ভবত বাকি চারজনও হাত আলগা করে ছিলেন একই চিন্তা থেকে। নইলে ওমন সুন্দর লাল গরুটা বুলেটের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো কি করে?
রাস্তার নিয়ন আলোয় আমরা দেখলাম, বাছুরটা প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই মিরপুর ছেড়ে কল্যাণপুর রাস্তায় হাওয়া হয়ে গেল।
পেছন পেছন ছুটছেন পশু ডাক্তার। গরুর গতির তুলনায় তার স্পিড দারুন কম।
তবু ছুটছেন।
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই।
বাবা আর কাকা হতবিহবল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরালাম।
গাঢ় রাত নেমেছে। সিগারেট টানতে টানতে মনে হলো, জীবনটা মন্দ না।
( এরপর আমাদের আর কাউকেই গরুর হাটে যেতে হয়নি, কোনোদিন। গত বছর কাকি আম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ডাক্তার কাকাও দারুন অসুস্থ, তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আবার বাবা দিনে দুইবেলা ইনসুলিন নিচ্ছেন। গতকালকেই তিনি পুরো দুই পিস কেক লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছেন। বুঝতে পারি তিনিও... ... ...
রাহাত থাকে সাইপ্রাসে। আহাদ, আফিয়া আপা, ইনায়েত ভাইও চলে যাচ্ছেন বাইরে। রাশেদ কাকার বয়স হয়ে গেছে, এখন আর তিনি খাটতে পারেন না। শেষ বয়সে তিনি গ্রামে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আছেন।
আমি জানি, কেউ ভরদুপুরে কলবেল বাজিয়ে বলবে না, সাদের মা, আমার টাকা পিকপকেট হয়ে গেছে। আর কোনো পারিবারিক মিটিংয়ে কাকি আম্মা কথা কয়ে উঠবেন না। বাবাকেও যেতে হয় না বাজারে। আহাদ রাহাত আর কোনোদিন পালিয়ে পর্বত সিনেমা হলে ঢুকে পড়বে না।
আমাদের জীবন আছে, গল্পগুলো কেবল হারিয়ে গেছে।
ঈদ মোবারক। )
#হাম্বা_মোবারক।
তখন স্কুল থেকে সবে পাশ করেছি। কাকি আম্মা ডেকে পাঠালেন। কাকি আম্মার ডাক অগ্রাহ্য করার সাহস আমাদের কারোরই ছিল না।
ড্রয়িংরুমে পারিবারিক মিটিং। আমি, আহাদ, রাহাত, ডাক্তার কাকা, বাবা, মা, রাশেদ কাকা। পারিবারিক বৈঠকের সভানেত্রী যথারীতি কাকি আম্মা।
আমাদের গরু কিনতে যেতে হবে। অন্য কারো হাতে এবার দায়িত্ব দেয়া যাবে না। আমরা এতোগুলো পুরুষ মানুষ ঘরে বসে কি করি?
গরুর হাটে যাবার কথা শুনে আব্বু মাথা চুলকাতে লাগলেন। ডাক্তার কাকা গভীর মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজের মধ্যে ডুব দিলেন। আমার মনে হলো এক্ষুণি একটা সিগারেট খাওয়া দরকার। কেবল আহাদ আর রাহাত দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলো। এই হাসির মানে আমি পরে বুঝেছি।
কাকা মৃদুস্বরে বললেন, কিন্তু এতো দূর থেকে গরু নিয়ে আসবো ক্যামনে?
কাকি আম্মা পরিষ্কার বলে দিলেন গরু বয়ে আনবার পদ্ধতি। গরুর পাশাপাশি রিকশা থাকবে। সেই রিকশায় থাকবেন আব্বু আর কাকা। গরুর দড়ি থাকবে তাদের হাতে। গরুর হাটবে, পাশাপাশি রিকশা চলবে।
পুরো বিষয়টা আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলুম। ঐরাবতের মতো গরু চলছে, পাশে রিকশায় বসা আব্বু আর কাকা। গরুর গলার দড়ি তাদের হাতে। পদ্ধতিটি আমার বেশ লাগলো।
কাকি আম্মা আমাদের হাতে টাকা দুই ভাগ করে দিয়ে দিলেন। যাতে টাকা চুরি না হয়, এজন্য দুইভাগে দেয়া হলো। পকেটমার হলে তো দুইজনের একসাথে হবে না।
আমাদের টিমে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দেয়ার জন্যে একজন পশু ডাক্তার রয়েছেন। তিনি গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবেন। আর মানুষের ডাক্তারের জন্য কাকা তো আছেনই। আমার বাবা আবার এডভোকেট। সাথে রয়েছি আমরা তিন তরুণ, আমি, আহাদ আর রাহাত
আমাদের পারিবারিক হেলপিং হ্যান্ড রাশেদ কাকা তো আছেনই। মানুষের ডাক্তার, পশু ডাক্তার, আইনজ্ঞ সব মিলিয়ে পুরো দক্ষ জনশক্তিবহুল একটি টিম যাকে বলে।
আমরা গেলাম গাবতলির গরুর হাটে। আহাদ আর রাহাত হাটে ঢোকার আগেই হাওয়া হয়ে গেলো। গরুর হাটে ঢোকার মুখেই পর্বত সিনেমা হল। সেখানে এক টিকেটে দুই ছবি চলছে। বিদেশী নায়িকাদের বুক চিতানো ছবি ওদেরকে টেনে নিয়ে গেলো হলের ভেতরে।
হাটে ঢুকে আমি চমকে গেলাম। গাবতলির গরুর হাট। হাজারে হাজারে গরু সারিবদ্ধভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা। একবার মনে হলো যদি সব গরুর দড়ি ছুটে যায়, তাহলে দেশে একটা ''গরু ক্যু'' হয়ে যাওয়া ওয়ান টু'র ব্যাপার। ভাগ্যিস দড়ি দিয়ে ওদেরকে বেঁধে রাখা হয়েছে।
হাটে ঢুকে প্রথম প্রহরে গরুর লাথি খেয়ে আব্বু কেতরে পড়ে গেলেন। ডাক্তার কাকা পা পরীক্ষা করে বললেন, কমপ্লিট ফ্রাকচার।
এর দশ মিনিটের মাথায় ডাক্তার কাকা ঘামতে শুরু করলেন। এই লক্ষণ আমার খুবই পরিচিত। আমি বললাম, কি কাকা? টাকা কি পকেটমার হয়ে গেছে?
কাকা মাথা নাড়লেন।
টাকা হারানোর ব্যাপারে আমার বাবা এবং কাকার প্রবাবতুল্য খ্যাতি রয়েছে। এই বিষয়ে তারা দুইজনেই জীবন্ত কিংবদন্তী। বাজারে যাওয়ার পথে প্রায়ই কাকা টাকা হারিয়ে ফেলেন এবং খালি বাজারের ব্যাগ হাতে আমাদের বাসায় চলেন আসেন। কাকি আম্মার বকুনির ভয়ে বাসায় ফেরেন না। ঘরে ঢুকেই বলেন, ও সাদের মা, আমার তো টাকা পিকপকেট হয়ে গেলো।
কাকাকে সাত্বনা দেয়ার জন্য লেবুর শরবত বানানো হয়। কাকা সবিস্তারে টাকা হারানোর গল্প করেন। তারপর দুপুরে আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করি। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বিকেলের দিকে কাকা বাড়ি ফেরেন।
অনেকদিন বাজারে গিয়ে বাবাও ফেরেন না। দুপুর গড়িয়ে গেলেই আমরা বুঝি বাবা টাকা হারিয়ে এখন কাকার ওখানে। হয়তো লেবু শরবত খাচ্ছেন ওই বাসায়। ভাতটাত খেয়ে বিকেলের দিকে বাসায় ফিরবেন।
এ সমস্তই চেনা গল্প।
কাজেই কাকার টাকা হারানোর সংবাদে আমি বিচলিত হলুম না।
পশু ডাক্তার অসাধ্য সাধন করলেন। অর্ধেক টাকা দিয়ে তিনি বিশ মিনিটের মাথায় একটা ''কিশোর গরু'' কিনে ফেললেন।
তখনই জানলাম, গরু কেনার পর ''হাসিল'' করতে হয়। গরুর মোট মূল্যের উপর একটা পার্সেন্টেজ জমা দিতে হয়। এই গরুর ইনকাম ট্যাক্সকেই হাসিল বলে।
হাসিলের জন্য আমরা লাইনে দাঁড়ালুম। ঠিক তৎক্ষণাৎ কারেন্ট চলে গেলো। অন্ধকারে টের পেলাম আমার পাশ দিয়ে পাই পাই করে কয়েকটি গরুর ছুটে বেরিয়ে গেলো। সাথে সাথেই কলরব, গরু ছুটছে, ধর; গরু ছুটছে, ধর। দড়ির ফাঁস দিয়ে লোকজন ছোটাছুটি অন্ধকারে শুরু করলো। এবং অতি বিস্ময়ের আবিষ্কার করলাম, কেউ একজন অন্ধকারে আমার গলায় দড়ি পড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
একবার ভাবলাম বলি, ভাই আমি মানুষ, গরু না।
তারপর মনে হলো, কি লাভ? গরু যদি মানুষের গলায় কথা বলে ওঠে, তাহলে কি কান্ড হয়ে যায়। তারচেয়ে কারেন্ট আসুক, আলোতে গরু মানুষ আলাদা করা যাবে। মনে মনে গাইলাম,
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।
হাসিল শেষে গরু নিয়ে আমরা হাট থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলাম। পিচ্চি গরু হলে কি হবে, ভীষণ তেজ। সকল বাঁধন ছেড়ে সে ছুটে পালাতে চায়। সতর্কতার জন্য আমরা পাঁচজনই দড়ি ধরে রেখেছি।
সেই সময় মনে হলো, বাকি চারজন তো দড়ি ধরে রেখেছেন। আমার কীসের ঠ্যাকা? আমি হাত আলগা করলাম।
খুব সম্ভবত বাকি চারজনও হাত আলগা করে ছিলেন একই চিন্তা থেকে। নইলে ওমন সুন্দর লাল গরুটা বুলেটের মতো ছুটে বেরিয়ে গেলো কি করে?
রাস্তার নিয়ন আলোয় আমরা দেখলাম, বাছুরটা প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই মিরপুর ছেড়ে কল্যাণপুর রাস্তায় হাওয়া হয়ে গেল।
পেছন পেছন ছুটছেন পশু ডাক্তার। গরুর গতির তুলনায় তার স্পিড দারুন কম।
তবু ছুটছেন।
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই।
বাবা আর কাকা হতবিহবল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরালাম।
গাঢ় রাত নেমেছে। সিগারেট টানতে টানতে মনে হলো, জীবনটা মন্দ না।
( এরপর আমাদের আর কাউকেই গরুর হাটে যেতে হয়নি, কোনোদিন। গত বছর কাকি আম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ডাক্তার কাকাও দারুন অসুস্থ, তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আবার বাবা দিনে দুইবেলা ইনসুলিন নিচ্ছেন। গতকালকেই তিনি পুরো দুই পিস কেক লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছেন। বুঝতে পারি তিনিও... ... ...
রাহাত থাকে সাইপ্রাসে। আহাদ, আফিয়া আপা, ইনায়েত ভাইও চলে যাচ্ছেন বাইরে। রাশেদ কাকার বয়স হয়ে গেছে, এখন আর তিনি খাটতে পারেন না। শেষ বয়সে তিনি গ্রামে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আছেন।
আমি জানি, কেউ ভরদুপুরে কলবেল বাজিয়ে বলবে না, সাদের মা, আমার টাকা পিকপকেট হয়ে গেছে। আর কোনো পারিবারিক মিটিংয়ে কাকি আম্মা কথা কয়ে উঠবেন না। বাবাকেও যেতে হয় না বাজারে। আহাদ রাহাত আর কোনোদিন পালিয়ে পর্বত সিনেমা হলে ঢুকে পড়বে না।
আমাদের জীবন আছে, গল্পগুলো কেবল হারিয়ে গেছে।
ঈদ মোবারক। )
#হাম্বা_মোবারক।
Comments
Post a Comment