আজ আমার মধুসুদন দাদার গল্প বলতে ইচ্ছে করছে।
সে অনেক অনেক আগের কথা। এক দেশে ছিল এক হতদরিদ্র মা। তার একটাই ছেলে। ধরা যাক, ছেলেটার নাম গোপাল।
গোপালের বয়স ৫ কি ৬। সে গ্রামের পাঠশালায় পড়ে। তার বাড়ি থেকে পাঠশালা অনেক দূরে। পাঠশালায় যেতে হলে একটা নির্জন বনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ভয়াল বিপদসংকুল সেই বন। গোপাল নিতান্তই বাচ্চা ছেলে। বনের ভেতর দিয়ে পথ চলতে তার ভয় লাগে।
মা গোপালকে সাহস দেবার জন্য বললেন, বনের ভেতর কখনো ডরাইস না, গোপাল। তোর একজন দাদা আছে। নাম মধুসুদন। যদি কখনো বনের ভেতর হারাই যাস, ভয় লাগে, তাইলে মধুসুদন দাদার কথা ভাববি। মাথায় রাখবি, মধুসুদন দাদা আছে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নাই। বুঝলি বাবা?
গোপাল মাথা নাড়লো।
আসলে মধুসুদন বলে কেউ ছিল না। অসহায় মা তার ছেলের মনে সাহস যোগানোর জন্য বানোয়াট মধুসুদনের গল্প শুনিয়েছিলেন। যাতে তার ছেলে ভয় না পায়। সাহস না হারায়।
এরপর থেকে গোপাল মহা আনন্দে পাঠশালায় যায়। তার একটুও ভয় লাগে না। বনের ভেতর মধুসুদন দাদা তো আছেই। বিপদে পড়লে তিনিই এগিয়ে আসবেন।
দিনের পর দিন গোপাল নির্ভিক চিত্তে বন বেরিয়ে পাঠশালায় যেতে লাগলো।
এর মধ্যে এক কান্ড ঘটলো।
পাঠশালায় পিকনিক টাইপের কোনো ব্যাপার হবে। স্কুলের সব ছাত্ররা কিছু না কিছু চাঁদা দেবে। কেউ দেবে চাল। কেউ দেবে সবজি। কেউ দেবে লবণ। কেউ দেবে মশলা। কিন্তু গোপাল কি দেবে?
পন্ডিত মশাই গোপালকে বললেন, কি রে গোপাল, স্কুলের ভোজসভায় তুই কি দিবি?
গোপাল বাড়ি ফিরে মাকে বললো। মা শুকনো মুখে বললেন, বাবা, আমরা তো নিজেরাই খাইতে পাই না। আমরা কোথা থেকে চাঁদা দিমু।
গোপাল পরদিন পাঠশালায় গিয়ে জানালো, সে কিছুই দিতে পারবে না। পন্ডিত মশাই শুনে মুখ ভেংচে বললেন, তুই কিছুই দিবি না? শুধু খাবি? বাহ, এই না হলে গোপাল।
পন্ডিত মশাইয়ের ব্যঙ্গ শুনে ক্লাসের সব ছাত্ররা হেসে গড়াগড়ি।
অতটুকু বাচ্চা গোপাল। তারও তো মান অপমান বোধ আছে। গোপাল তাই আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছে। বনের মধ্য দিয়ে। এমন সময় একজন লোক হুট করে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল, কাঁদছো কেন?
গোপাল চমকে উঠলো। বলল, কে তুমি?
লোকটা মিষ্টি হেসে বলল, আমাকে চেনো না? আশ্চর্য। আমিই তো তোমার মধুসুদন দাদা। কাঁদছো কেন ভাইটি?
গোপাল সব খুলে বলল।
লোকটা তখন হেসে বলল, ও এই সমস্যা? তুমি তোমার পন্ডিত মশাইকে গিয়ে বলবে যে, স্কুলের পিকনিকের সবচেয়ে দামী চাঁদা তুমি দেবে। পিকনিকে স্কুলের সবাইকে তুমি ভরপেট দই খাওয়াবে। যে যত খেতে পারে। আমি তোমাকে দই দেবো।
গোপাল সরলমনে কথাটা বিশ্বাস করলো। সে মহাখুশি হয়ে দৌড়ে স্কুলে ফিরে গিয়ে সবাইকে দই খাওয়ানোর ঘোষণা দিল।
তার মতো গরীব ছেলের এই কথা শুনে আরেক দফা হাসাহাসি হলো।
যাই হোক। যথাসময়ে স্কুলের পিকনিক।
সবাই খেতে বসেছে। গোপালের দেখা নেই। এটাই নিয়ে বেশ হাসাহাসি হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। পন্ডিত মশাই মুখ ভেংচে বলছেন, আমাদের গোপাল বাবুর দই নিয়ে আসার কথা। গোপাল বাবু নিজেই এখন দই হয়ে গেছেন। ওর নাম এখন থেকে গোপাল না দইপাল। হা হা হা।
ভোজসভার শেষ দিকে গোপাল ছোট্ট একটা দইয়ের হাড়ি নিয়ে হাজির। খুবই ছোট্ট হাড়ি।
গোপালের দইয়ের হাড়ি দেখে হাসাহাসি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো। পন্ডিত মশাই মুখ খিঁচিয়ে বললেন, হতচ্ছাড়া। এই তোর দই? এটা দিয়ে তো একজনের খাওয়া হবে না।
গোপাল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কিন্তু মধুসুদন দাদা যে বললেন এটাতেই হয়ে যাবে।
পন্ডিত মশাই গেলেন খেপে। রাখ তোর মধুসুদন দাদা। মধুসুদনের পিন্ডি চটাকাই। ফাইজলামি করো আমার সাথে ...
এরপর খেপে গিয়ে পন্ডিত মশাই একজনের পাতে সেই দইয়ের হাড়ি উপুর করে ধরলেন।
আশ্চর্যজনক ঘটনা তখনই ঘটলো। ছোট্ট ওই হাড়ি থেকে দই বেরুচ্ছেই। স্কুলের সবাই ঠেসে দই খেলো। তবুও সেই হাড়ির দই ফুরায় না। পাড়ার সবাইকে দই দেয়া হলো, তবুও সেই হাড়ি ফাঁকা হয় না। গোটা গ্রামের সবাইকে দই বিতরণ করা হয়, পাত্র তবুও শূণ্য হলো না।
পন্ডিত মশাই এবার ভড়কে গেলেন। বললেন, কে দিয়েছে এই হাড়ি? কে এই মধুসুদন দাদা ?
গোপাল জানালো, মধুসুদন দাদা বনের মধ্যে থাকেন। তিনি সবার দাদা।
পন্ডিত মশাই আরও খেপে গেলেন। বললেন, যে বনের ত্রিসীমানায় মানুষ থাকে না, সেই বনে তোর মধুসুদন দাদা থাকে। চল বনে চল। তোর মধুসুদন দাদাকে দেখবো। দেখি তিনি কেমন দাদা ...
পন্ডিত মশাইকে নিয়ে গোপাল বনে এলো। কিন্তু বনের কোথাও মধুসুদন দাদাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এক সময় গোপাল ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো। ও মধুসুদন দাদা, তুমি গেলে কোথায়? তুমি গেলে কোথায়?
তখন আকাশ থেকে ভেসে এলো একটা কন্ঠস্বর। গোপাল, আমি তোমার মধুসুদন দাদা বলছি। তোমার পন্ডিত মশাইয়ের সামনে আমি আসবো না। তুমি আমাকে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করেছিলে। আমাকে বিশ্বাস করে দিনের পর দিন, এমনকি ভর সন্ধ্যেবেলায় তুমি বনের মধ্যে পথ চলেছো। তোমার বিশ্বাস ছিল বলেই আমি তোমার কাছে এসেছিলাম। বিশ্বাস রেখো, আবারও আসবো। কিন্তু তোমার পন্ডিত মশাই তো বিশ্বাস করেনি। যার বিশ্বাস নেই, তার মধুসুদন দাদাও নেই। মধুসুদন দাদা তার সামনে কখনো আসে না।
এই গল্পটা আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম।
এবং একসময় আমি গোপাল ছিলাম। তাই আমার মধুসুদন দাদাও ছিল। ধীরে ধীরে লেখাপড়া শিখে মস্ত পন্ডিত হয়ে গেছি। আমার জীবন থেকে তাই মধুসুদন দাদাও হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছে জীবনের অমৃত ভান্ড।
মধুসুদন দাদা, আমি আবার গোপাল হয়ে এসেছি।
ও মধুসুদন দাদা, কোথায় গেলে তুমি?
আসো, আসো, আমি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছি।
আমার ভুল হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখ করো না, বাঁচো !

এক টুকরো আকাশ !